বাংলাদেশে যখন প্রথম স্বল্প মূল্যের চাইনিজ ট্যাব আসা শুরু করেছিল তখন অনেকের কাছেই সেটি হাসির পাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল চাইনিজ ফোনের মতোই হয়তো এসব ট্যাবও খুব বেশিদিন টিকবেনা। কিন্তু সবার ভুল ভাঙতে খুব বেশি দেরি হয়নি যার প্রমাণ বর্তমান প্রযুক্তি বাজারেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ বাজারে এখন স্বল্পমূল্যের ট্যাবগুলোর চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। আর চাহিদা বাড়বে নাই বা কেন? একের পর এক চমক যে নিয়ে আসছে এর প্রস্তুতকারীরা!
বাংলাদেশে যারা এধরনের ট্যাব আনা শুরু করেছিল তাদের মাঝে অন্যতম হলো Gadget Gang 7। প্রথম দিকে আইনল দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তিতে তারা ওনডা ও রামোস এর মত অসাধারণ বিল্ড কোয়ালিটিসমৃদ্ধ স্বল্পমূল্যের চাইনিজ ট্যাব আনা শুরু করে যা অ্যান্ড্রয়েডকে বাংলাদেশের সাধারন মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসে। তবে এবার আর অন্য ব্র্যান্ড নয়, তারা নিয়ে এসেছে নিজেদের ব্র্যান্ডেরই ট্যাব Gadget Gang 7 Neo 3G। আজ এ ট্যাবটিরই হ্যান্ডস অন রিভিউ করছি।
Gadget Gang 7 Neo 3G
গ্যাজেট গ্যাং সেভেনের ৭” আকারের এই ট্যাবটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর ফোন কলিং ও থ্রিজি সিম সাপোর্ট। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই স্বল্পমূল্যে বিভিন্ন ট্যাবলেটের ছড়াছড়ি থাকলেও ৩জি সিম সুবিধাসহ ট্যাবলেটের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তবে সেই অনুপাতে যথেষ্ট ট্যাবলেট বাজারে নেই। তাই চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখেই এই ট্যাবলেটে ৩জি সুবিধা যোগ করা হয়েছে যা ট্যাবটির অন্যতম প্রধান সুবিধা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
তাছাড়া এতে ব্লুটুথ ও জিপিএসও রয়েছে যা স্বল্পমূল্যের বেশিরভাগ ট্যাবের চেয়ে একে আলাদা করে রাখে। তাই আপনি চাইলে আপনার স্মার্টফোনের বিকল্প হিসেবেও একে ব্যবহার করতে পারেন। এবার ট্যাবটির বিভিন্ন দিক একে একে দেখে নেয়া যাক।
ডিজাইন
নিও ৩জি ট্যাবের সামনের দিকটা ঝকঝকে থাকায় দেখতে বেশ ভালোই লাগে। ডিভাইসটির উপরে আর নিচের দিকে কিছুটা অংশ প্লাস্টিক আর বাকিটুকু অ্যালুমিনিয়াম।
Gadget Gang 7 Neo 3G ট্যাবের পেছনটায় ম্যাট ডিজাইন থাকায় এতে স্ক্র্যাচ পড়ার সম্ভাবনা কম। এছাড়া ট্যাবটি দেখতেও বেশ স্মার্ট ও স্লিম। তবে ট্যাবটির উপরের অংশে পোর্টগুলো একটি আলাদা কভার দিয়ে ঢাকা থাকে যেটি বারবার খুললে বা বন্ধ করলে ভেঙে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে; অন্তত আমাদের তাই মনে হয়েছে। এই সমস্যাটি ছাড়া ডিজাইনের দিক থেকে ট্যাবটিকে বেশ ভালই বলা যায়।
সিপিইউ ও জিপিইউ
গ্যাজেট গ্যাং সেভেন তাদের এই ট্যাবটিতে করটেক্স এ৯ ডুয়াল কোর ১ গিগাহার্জ এমটিকে৬৫৭৭ প্রসেসর ব্যবহার করেছে। আর জিপিইউ হিসেবে রয়েছে পাওয়ারভিআর এসজিএক্স৫৩১ আলট্রা জিপিইউ।
সিপিইউ ও জিপিইউ এর দিক থেকে ট্যাবটির সাথে মাইক্রোম্যাক্স এ১১০ ক্যানভাস ২ এর সাথে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তাই বুঝতেই পারছেন ট্যাবটির পারফরম্যান্স কোন অংশেই ক্যানভাস ২ এর থেকে কম হবে না। এমনকি ক্যানভাস ২ এর চেয়েও এর পারফরম্যান্স আরও ভাল হতে পারে। এ জন্য অন্য ফিচারগুলো দেখা যাক।
র্যাম ও স্টোরেজ
গ্যাজেট গ্যাং ৭ নিও ৩জি ট্যাবটিতে রয়েছে ৪ গিগাবাইট ইন্টারনাল স্টোরেজ যার মাঝে ২ গিগাবাইট আপনি অ্যাপ্লিকেশন ইন্সটলের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। তাছাড়া স্টোরেজ বাড়ানোর জন্য এসডি কার্ড স্লটও রয়েছে।
এছাড়া ট্যাবটিতে রয়েছে ১ গিগাবাইট র্যাম। এ কারণেই একে আমি ক্যানভাস ২ এর চেয়ে এগিয়ে রাখছি কারণ ক্যানভাস ২-এ রয়েছে ৫১২ মেগাবাইট র্যাম।
ডিসপ্লে
গ্যাজেট গ্যাং সেভেন নিও ৩জি ট্যাবে রয়েছে ৭ ইঞ্চি আকারের ৫ পয়েন্ট ক্যাপাসিটিভ টাচ সমৃদ্ধ IPS ডিসপ্লে যার ভিউইং অ্যাংগেল ১৮০ ডিগ্রী। অর্থাৎ যেকোন দিক থেকেই ট্যাবটির ডিসপ্লে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এর রেজুলেশন হলো ১০২৪*৬০০ পিক্সেল। এইচডি ভিডিও চালাতে ট্যাবটির খুব একটা সমস্যা হয়না, শুধু প্লেব্যাকের সময় ফরওয়ার্ড করলে সামান্য ল্যাগ ছাড়া আমরা তেমন কোন সমস্যা পাইনি।
তাছাড়া ডিসপ্লেটি দেখতেও বেশ উজ্জ্বল। রোদের মাঝেও সহজেই এটি ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া এর টাচ রেসপন্সও বেশ ভাল। ডিসপ্লের দিক দিয়ে ট্যাবটিকে রেটিং করলে একে ৫ এর মাঝে ৪ দেয়া যায়।
ক্যামেরা
ট্যাবটির আরেকটি বড় চমক হলো এর ক্যামেরা। এর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী ৮ মেগাপিক্সেলের ডুয়াল ফ্ল্যাশসহ অটোফোকাস ক্যামেরা যা ট্যাবটিকে অন্য ট্যাবগুলোর চেয়ে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এর পিকচার কোয়ালিটি আসলেই অসাধারণ, কোন অংশেই এটিকে ফোনের ক্যামেরা থেকে কম বলা যায়না। তাছাড়া ভিডিও কলের জন্য ০.৩ মেগাপিক্সেলের ফ্রন্ট ক্যামেরা তো আছেই।
বেঞ্চমার্ক
ট্যাব কেনার পরই এর সামর্থ্য যাচাই করার জন্য সবাই-ই মূলত বেঞ্চমার্ক করে থাকেন। তাই হ্যান্ডস-অন রিভিউ এর জন্য আমরাও ট্যাবটি বেঞ্চমার্ক করে দেখেছি। Antutu Benchmark এ ট্যাবটির স্কোর এসেছে ৬২০১।
অন্যন্য ট্যাবের তুলনায় এর বেঞ্চমার্ক স্কোর কিছুটা কম হলেও পারফরম্যান্স এর দিক দিয়ে আমরা তেমন কোন নেতিবাচক দিক খুঁজে পাইনি। কেননা হাই গ্রাফিক্সের গেম টেস্টের সময়ই যেকোন ট্যাবের আসল পারফরম্যান্স সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় যেদিক দিয়ে ট্যাবটিকে সফলই বলা চলে। এবার তাহলে গেমিং এর দিকটা দেখে নেয়া যাক।
গেমিং
গেমিং পারফরম্যান্সের সাহায্যেই আমরা মূলত একটি ট্যাবের পারফরম্যান্স সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আর এজন্য মূলত গ্র্যান্ড থেফট অটো সিরিজের গেমগুলো দিয়েই আমরা পরীক্ষা করে থাকি। কারণ এসব গেম চালানোর বেশ ভাল পরিমান র্যাম ও দ্রুত গতির প্রসেসর ও জিপিইউ এর প্রয়োজন হয়।
আগেই বলেছি এই ট্যাবটিতে গেমিং এর জন্য রয়েছে করটেক্স এ৯ ডুয়াল কোর ১ গিগাহার্জ এমটিকে৬৫৭৭ প্রসেসর আর পাওয়ারভিআর এসজিএক্স৫৩১ আলট্রা জিপিইউ। ট্যাবটিতে আমরা ভাইস সিটি সহ টেম্পল রান ও ডেড ট্রিগার এর মতো হাই গ্রাফিক্সের গেমগুলো রান করে দেখেছি। সবগুলো গেমই সাধারন কোয়ালিটিতে কোন ল্যাগ ছাড়াই চলে। তবে ফুল গ্রাফিক্স দিলে সামান্য ল্যাগ দেখা যায়। অবশ্য খুব হাই কনফিগারেশনের ট্যাব ছাড়া সাধারণত সব ট্যাবেই ফুল গ্রাফিক্স দিলে সামান্য ল্যাগ লক্ষ্য করা যায়।
ব্যাটারি ব্যাকআপ
ট্যাবটিতে 4200 mAh এর ব্যাটারি থাকার কথা বলা হলেও আমাদের ধারণা এটিতে অন্তত 5000 mAh এর শক্তিশালী ব্যাটারি রয়েছে কারণ সাধারণ ব্যবহারে আমরা এর ব্যাটারি ব্যাকআপ পেয়েছি প্রায় ১২ ঘন্টা! ৩জি চালু অবস্থাতেই ট্যাবটি প্রায় ৬-৭ ঘন্টা ব্যাকআপ দিতে পারে। এমনকি এইচডি ভিডিও প্লেব্যাক করলেও টানা প্রায় ৯-১০ ঘন্টা ব্যাকআপ দিতে পারে এই ট্যাব।
যেসব কারনে অনন্য এই ট্যাব
আগেই বলেছি অন্য সব ট্যাব থেকে এটির আলাদা হবার কারণ এর ভিডিও ফোন কলিং ও ৩জি সিম সাপোর্ট। এছাড়াও এতে রয়েছে অ্যান্ড্রয়েড ৪.১ জেলিবিন যাতে ফ্যাবলেট ইউজার ইন্টারফেস দেয়া হয়েছে। রয়েছে ওয়াইফাই, ব্লুটুথ ৪, জিপিএস, অ্যাক্সেলেরোমিটার সেন্সর, অ্যামবিয়েন্ট লাইট সেন্সর, প্রক্সিমিটি সেন্সর এবং ভাইব্রেশন মোটর। অর্থাৎ, একটি স্মার্টফোনের সব ফিচারই আপনি এই ট্যাবটিতে পাচ্ছেন।
তবে বোনাস হিসেবে গ্যাজেট গ্যাং সেভেন ট্যাবটিতে আরো একটি চমক রেখেছে। অনেক অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে এফএম রেডিও থাকলেও গ্যাজেট গ্যাং সেভেনই প্রথম তাদের এই ট্যাবটিতে অ্যানালগ টেলিভিশনও রেখেছে। ফলে এর মাঝে থাকা অ্যান্টেনার মাধ্যমেই আপনি টিভিও দেখতে পারবেন। আর টিভি যেহেতু দেখতে পারবেন তাহলে বুঝতেই পারছেন এতে এফএম রেডিও-ও রয়েছে।
এছাড়া এতে রয়েছে ডুয়াল স্পিকার, একটি সিম স্লট, একটি মাইক্রো ইউএসবি পোর্ট, ৩.৫ মিমি হেডফোনের পোর্ট এবং ভলিউম কন্ট্রোল ও পাওয়ার বাটন। নেট ব্রাউজিং এর জন্যও ট্যাবটি যথেষ্ট ভালো।
সমস্যা
ট্যাবটিতে অনেক সুবিধা থাকলেও এর মাঝে কিছু বাগও রয়েছে। যেমন ডিভাইসটির কার্নেলে ওটিজি সাপোর্ট দেয়া হয়নি। ফলে ওটিজি ক্যাবলের মাধ্যমে পেনড্রাইভ, মাউস, কীবোর্ডের মত ইউএসবি ডিভাইস আপাতত ব্যবহার করতে পারবেন না। গ্যাজেট গ্যাং সেভেন এই সমস্যাটা সমাধান না করা পর্যন্ত আমাদের পরামর্শ থাকবে এই ট্যাবটিতে ওটিজি ব্যবহার না করতে। কেননা, যেকোনো সময় এতে ট্যাবের ক্ষতি হতে পারে।
আরেকটি সমস্যা হলো ডিভাইসটি দিয়ে কোন স্ক্রিনশট নেয়া যায়না। এতে স্ক্রিনশট নেয়ার জন্য ভেতরে কোন অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে দেয়া হয়নি। তাছাড়া নো রুট স্ক্রিনশট-এর মতো স্ক্রিনশট নেয়ার অ্যাপ্লিকেশনগুলোও এতে কাজ করেনা।
এবার সর্বশেষ সমস্যাটি হলো রুট করা নিয়ে। ডিভাইসটি কোনভাবেই আমরা রুট করতে পারিনি। অর্থাৎ, রুট করার জন্য কোন পথই ডিভাইসটিতে খোলা রাখা হয়নি। তবে আমরা Gadget Gang 7 কে অনুরোধ করেছি বাজারে আনার আগে যেন সবগুলো ডিভাইসকে রুট করেই আনা হয় এবং তারা এটি বিবেচনা করবে বলেও জানিয়েছে।
যদি তারা এমনটি করে তবে বাংলাদেশে তারাই সর্বপ্রথম রুটেড ডিভাইস বিক্রেতা হবেন যা ক্রেতাদেরকে তাদের ডিভাইস আরো স্বাধীনভাবে ব্যবহার করার পথ খুলে দেবে। তাছাড়া ডিভাইসটি রুট করা গেলে স্ক্রিনশট নেয়ার সমস্যাটিও সমাধান করা যাবে। এমনকি ওটিজি সাপোর্ট নিয়েও তখন কাজ করা সম্ভব হবে।
সিদ্ধান্ত
ট্যাবটির প্রায় সবকিছুই আমি এখানে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। এবার দাম ও সিদ্ধান্ত নেবার পালা। গ্যাজেট গ্যাং সেভেনের পক্ষ থেকে ট্যাবটির দাম রাখা হয়েছে ১৯,৭০০ টাকা। তবে ট্যাবটি এখনো গ্যাজেট গ্যাং সেভেনে আসেনি। বর্তমানে তারা শুধু প্রিঅর্ডার নিচ্ছে।
যে কেউ চাইলে ডিভাইসটি তাদের অফিসে গিয়ে দেখে এরপর অর্ডার করতে পারবেন। আর ট্যাবটি পেতেও খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবেনা, মার্চের ১৫ তারিখ থেকেই ট্যাবটির বিক্রি শুরু হবে বলে Gadget Gang 7 এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
আরও একটি বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেয়া জরুরি বলে মনে করছি। ট্যাবটি সাধারনের হাতে আসার আগেই প্রি-অর্ডারের জন্য যখন গ্যাজেট গ্যাং সেভেন ও অ্যান্ড্রয়েড কথন থেকে প্রচার করা হয়েছিল তখন কিছু ব্যক্তি ট্যাবটি ব্যবহার না করেই ট্যাবটির গেম ও অ্যাপ্লিকেশন সাপোর্ট সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিল যার সত্যতা কতটুকু সেটা আপনারা রিভিউতেই দেখতে পাচ্ছেন। এমন মন্তব্যে সবাইকে বিভ্রান্ত না হবার জন্য অনুরোধ থাকলো। তবে ট্যাব কেনার পর কেউ যদি কোনো রকম সমস্যার সম্মুখীন হন তাহলে তা অবশ্যই আমাদের জানাবেন।
আপনি যদি ট্যাবটি কিনতে চান তাহলে সেখানে যেয়ে নিজ হাতে দেখে নেয়ার পরামর্শ থাকবে।
আপনার কী মনে হয় ট্যাবটি থ্রিজি ট্যাবের বাজারে রাজত্ব করতে পারবে ? মন্তব্যের ঘরে সেটি জানাতে ভুলবেন না। আর এমন আরো নতুন ডিভাইসের রিভিউ এর জন্য ফেসবুকে লাইক দিন অ্যান্ড্রয়েড কথন এর পাতায়।
রিভিউটি লিখতে ও ডিভাইস টেস্টিং-এ রাহাত রহমান-এর সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন অ্যান্ড্রয়েড কথনের সিনিয়র টেকনিক্যাল এক্সিকিউটিভ এস এম তাহমিদ।