কমদামে কোনটি কিনবেন: মটো জি বনাম নকিয়া লুমিয়া ৬২৫

স্বল্পমূল্যের স্মার্টফোনের বাজারটা বেশ অনেকদিন ধরেই বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠছে। স্মার্টফোন জগতে রাজত্ব করছে অ্যান্ড্রয়েড, আর তা সম্ভব হওয়ার পেছনে স্বল্পমূল্যে অ্যান্ড্রয়েড-চালিত ফোন সহজলভ্য হওয়া অন্যতম প্রধান কারণ। আর তাই এবার কম দামের এবং তুলনামূলক কম শক্তিশালী হার্ডওয়্যারের স্মার্টফোন তৈরির দিকে নজর দিতে শুরু করেছে কোম্পানিরা। গুগল তাদের সাম্প্রতিক অ্যান্ড্রয়েড ৪.৪ কিটক্যাট বিশেষ করে লো-এন্ড অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসের জন্য উপযোগী করে তৈরি করেছে বলে জানিয়েছে। আর এবার মটোরোলা মটো জি নামে একেবারেই অবিশ্বাস্য কম দামে এনেছে তাদের নতুন অ্যান্ড্রয়েড ফোন, যেটিতে শিগগিরই অ্যান্ড্রয়েড ৪.৪ দেয়া হবে বলে তারা জানিয়েছে।

মটো জি

কিন্তু কমদামে স্মার্টফোন বললেই তো আর অ্যান্ড্রয়েড বোঝানো যায় না। অন্যান্য ব্র্যান্ডেরও রয়েছে কমদামী অ্যান্ড্রয়েড ফোন। যেহেতু অ্যাপলের “কমদামী” কোনো ফোন নেই, সেহেতু বাজেট-বান্ধব ফোনের বাজারে অ্যান্ড্রয়েডের প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী হলো উইন্ডোজ ফোন। অন্য ভাষায়, নকিয়া লুমিয়া।

নকিয়া এক সময় মোবাইল জগতে রাজত্ব করলেও অ্যান্ড্রয়েড বা স্মার্টফোনের বিপ্লবের পর থেকেই তারা বাজার হারাতে শুরু করে। তার বিশেষ কারণও রয়েছে অবশ্য। নকিয়া লুমিয়ার ‘কমদামী’ বা ‘বাজেট-বান্ধব’ ফোনটিও অনেক ক্রেতার কাছেই ততোটা বাজেট-বান্ধব বা কমদামী বলে মনে হবে না। যদিও অনেকেই বলেন নকিয়া লুমিয়ার লো-এন্ড ফোনেও অনেকটা হাই-এন্ডের মতোই পারফরম্যান্স পাওয়া যায়, তবুও যখন কাছাকাছি দামে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সঙ্গে লুমিয়ার তুলনা করতে যাবেন, তখন দারুণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষ করে এখন যেহেতু গুগল কমদামী ফোনের দিকে নজর দিতে শুরু করেছে।

তাহলে কমদামে কোনটি কিনবেন? কমদামী অ্যান্ড্রয়েড নাকি উইন্ডোজ ফোন?

চলুন আজ তুলনা করা যাক সম্প্রতি উন্মুক্ত হওয়া মটো জি এবং লুমিয়া সিরিজের তুলনামূলক কমদামী ফোন নকিয়া লুমিয়া ৬২৫-এর মধ্যে।

ডিজাইন

মটো জি

মটো জি দেখে প্রায় সব প্রযুক্তি বিশারদরাই মন্তব্য করেছেন যে, অনেকটা মটো এক্স-এর আদলেই তৈরি করা হয়েছে এটি। যদিও মটো এক্স-এর মতো এক্সটেনসিভ কাস্টোমাইজেশনের সুবিধা নেই মটো জি-তে, তবুও এর সাধারণ কালো ব্যাক কভারের পাশাপাশি আরও কিছু উজ্জ্বল রঙের কভার রয়েছে, যার মাধ্যমে মটো জি-কে দেয়া সম্ভব দারুণ কিছু লুক। এছাড়াও লাল, সাদা, হলুদ ইত্যাদি বিভিন্ন রঙের ব্যাক কভারের সঙ্গে মিলিয়ে হেডফোন, কেইস, ফ্লিপ শেল ইত্যাদি অ্যাক্সেসরিজও রয়েছে। ফলে সবমিলিয়ে ফোনটি দেখতে সত্যিই দারুণ করে তুলেছে। পাশাপাশি পেছনের হালকা কার্ভ থাকার কারণে এটি হাতে ধরতেও বেশ আরামদায়ক, যা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অন্যদিকে লুমিয়া ৬২৫ একইভাবে উজ্জ্বল ও রঙিন। নকিয়া লুমিয়ার অন্যতম বিশেষত্বই এর উজ্জ্বল ও বাহারি রঙের ডিজাইন, যার কারণে আইফোন ৫সি বাজারে আসার পর অ্যাপলকে ‘নকল’ করার জন্য ‘ধন্যবাদ’ জানাতে দেরি করেনি নকিয়া।

লুমিয়া ৬২৫

লুমিয়া ৬২৫-এর পেছনটাও ধরতে বেশ আরামদায়ক এবং এর সঙ্গে একাধিক উজ্জ্বল রঙের ব্যাক কভার রয়েছে। এছাড়াও লুমিয়া ৬২৫ পুরো ফোনটিই অনেকটা ‘রাউন্ডেড কর্নার’ ফর্ম ফ্যাক্টরে তৈরি, যার ফলে এই ডিজাইন অনেকের কাছে আবার ভালো নাও লাগতে পারে; বিশেষ করে যারা বার-ফোন ডিজাইনের ভক্ত।

লুমিয়া ৬২৫ ও মটো জি – দু’টি ফোনেরই ব্যাক কভার বদলানোর সুবিধা থাকলেও বদলানোর কাজটা সহজ করতে যেন ভুলে গেছে নকিয়া ও মটোরোলা দু’টি কোম্পানিই। অর্থাৎ, কভার বদলে ফেললে ফোন নতুন রূপ ধারণ করবে ঠিকই, কিন্তু দু’টি ফোনের ব্যাক কভার খোলাই খানিকটা ঝক্কির কাজ বলে মনে হতে পারে। অবশ্য সেটা ব্যবহারকারীর উপর নির্ভর করে।

হার্ডওয়্যার

মটোরোলা মটো জি-এর উদ্বোধনের সময়ই মনে করিয়ে দিয়েছে যে, মটো জি একটি বাজেট ফোন। কম দাম ধরে রেখে এতে স্মার্টফোনে যতদূর সম্ভব ভালো অভিজ্ঞতা দেয়ার মতো করেই তৈরি করা হয়েছে মটো জি। আর এ কাজে মটোরোলা খুব একটা ভালো করেনি তা বলা যাবে না। যদিও এই কাজ করতে গিয়ে মটোরোলার মটো এক্স-এর দারুণ কিছু ফিচার মটো জি থেকে বাদ দিতে হয়েছে, কিন্তু সবমিলিয়ে দাম অনুপাতে সত্যিই দারুণ একটি ডিভাইস তৈরি করেছে মটোরোলা।

মটো জি-তে রয়েছে ৪.৫ ইঞ্চি আইপিএস ডিসপ্লে প্যানেল যার রেজুলেশন 1280×720 পিক্সেল। অন্যদিকে লুমিয়া ৬২৫-এ রয়েছে ৪.৭ ইঞ্চি ডিসপ্লে যার রেজুলেশন মাত্র 800×480 পিক্সেল। মটো জি ডিসপ্লের পিপিআই (পিক্সেল পার ইঞ্চি) হচ্ছে অবিশ্বাস্য ৩২৯ পিপিআই, যেখানে নকিয়া লুমিয়া ৬২৫-এর মাত্র ১৯৯ পিপিআই। অবশ্য এতো কম পিপিআই থাকার পরও উইন্ডোজ ফোন ৮-এর ব্যতিক্রমী ডিজাইন থাকার কারণে খুব একটি খারাপ অভিজ্ঞতা দেবে না লুমিয়া ৬২৫; কিন্তু তাই বলে একে মটো জি-এর সঙ্গে তুলনাও করা যাবে না!

মটো জি-তে রয়েছে ১.২ গিগাহার্জ কোয়াড-কোর কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন ৪০০ প্রসেসর এবং ১ গিগাবাইট র‌্যাম। এছাড়াও ৫ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা, ১.৩ মেগাপিক্সেল ফ্রন্ট ক্যামেরা ও ৮ কিংবা ১৬ গিগাবাইট ইন্টারনাল স্টোরেজ। তবে এতে মেমোরি কার্ডের জন্য কোনো স্লট নেই।

লুমিয়া ৬২৫

অন্যদিকে নকিয়া লুমিয়া ৬২৫-এ রয়েছে ১.২ গিগাহার্জ ডুয়াল-কোর কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন এস৪, ৫১২ মেগাবাইট র‌্যাম, ৫ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা, ভিজিএ ফ্রন্ট ক্যামেরা এবং ১৬ গিগাবাইট স্টোরেজ। পাশাপাশি এতে মেমোরি কার্ডের স্লট রয়েছে, যা মটো জি থেকে একে এক ধাপ এগিয়ে রেখেছে।

কিন্তু এসডি কার্ড স্লট দিয়ে এক ধাপ এগিয়ে গেলেও আসলেই কি মটো জি থেকে হার্ডওয়্যারের বিচারে এগিয়ে আছে লুমিয়া ৬২৫?

ক্যামেরা

লুমিয়া ৬২৫

লুমিয়া সিরিজের ফোনগুলোকে অনেকেই ক্যামেরার বিচারে আগেভাগেই এগিয়ে রাখেন। কিন্তু তাই বলে সব লুমিয়া ফোনের ক্যামেরাই কি “অসাধারণ” ছবি তুলতে সক্ষম?

হাই-এন্ড ফোনের ক্যামেরার চেয়ে লুমিয়া ৬২৫-এর মতো লো-এন্ড ফোনের ক্যামেরায় বেশ পার্থক্য রয়েছে। এতে নকিয়ার “প্রো” ক্যামেরা অ্যাপ্লিকেশন নেই বটে, কিন্তু তাই বলে একে একেবারে খারাপও বলা যাবে না। ছবি তোলায়ও লুমিয়া ৬২৫ যথেষ্টই দ্রুত। ফলে তেমন কোনো শাটার ল্যাগ ছাড়াই দ্রুত বন্ধুর ছবি তুলে ফেলতে পারবেন।

মটো জি

অন্যদিকে মটো জি-এর ক্যামেরাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এতে গুগলের নেক্সাস ডিভাইসে যেসব ক্যামেরা অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহৃত হয়, সেটার বদলে মটোরোলার নিজস্ব ক্যামেরা অ্যাপ্লিকেশন জুড়ে দেয়া হয়েছে। এটি যথেষ্টই সাধারণ ইউজার ইন্টারফেসের উপর তৈরি। এইচডিআর কিংবা স্লো-মো(শন) ভিডিও সেটিংসগুলো থাকলেও মটো জি-কে বেশ দ্রুত ক্যামেরা বলা যাবে না। ছবি ভালো আসলেও লুমিয়া ৬২৫-এর সঙ্গে ছবি তোলার দ্রুততার প্রতিযোগিতায় ফেললে কিঞ্চিৎ পিছিয়েই থাকতে পারে মটো জি।

সফটওয়্যার

এখানেই লুমিয়া ৬২৫ এবং মটো জি-এর অন্যতম প্রধান পার্থক্য নিহিত! সেই পার্থক্য, যেটি অনেক ব্যবহারকারীর সিদ্ধান্ত ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যাবার কারণ হতে পারে! লুমিয়া ৬২৫ চলছে উইন্ডোজ ফোন ৮-এ, যেখানে সম্প্রতি বাজারে আসা মটো জি-তে চলছে অ্যান্ড্রয়েড ৪.৩ জেলি বিন। মটোরোলা জানিয়েছে, জানুয়ারির মধ্যেই এতে অ্যান্ড্রয়েডের সর্বশেষ সংস্করণ অ্যান্ড্রয়েড ৪.৪ কিটক্যাট দিয়ে দেয়া হবে।

উইন্ডোজ ফোন বনাম অ্যান্ড্রয়েড তর্কে না গিয়ে এতটুকু বলে দেয়া যায় যে, দু’টি ফোনেরই আর্থিক দামের তুলনায় ইউজার এক্সপেরিয়েন্স যথেষ্ট ভালো। নিজ নিজ অপারেটিং সিস্টেমে দু’টি ফোনই বেশ ভালো কাজ করতে পারে। লুমিয়া ৬২৫ বা মটো জি – দু’টোর কোনোটাতেই তেমন কোনো ল্যাগ লক্ষ্য করা যায় না যেটি আপনাকে “সস্তার তিন অবস্থা” কথাটি মনে করিয়ে দেবে। এছাড়াও দু’টি ফোনেরই রয়েছে নিজস্ব বিশাল অ্যাপ্লিকেশনের স্টোর।

মটো জি

সফটওয়্যারের দিক দিয়ে পছন্দটা একেবারেই ব্যবহারকারীর উপর নির্ভর করে। আপনি যদি গুগলের ফ্যান হয়ে থাকেন, অ্যান্ড্রয়েডের ফ্যান হয়ে থাকেন, কিংবা গুগল সেবাসমূহের সঙ্গে নিজের দৈনন্দিন জীবন কিংবা কাজকর্মে অনেক বেশি যুক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে স্বভাবতঃই অ্যান্ড্রয়েড আপনার জন্য সেরা চয়েস হবে, যেটা এমনিতেই আপনার হাত বাড়িয়ে দেবে মটো জি-এর প্রতি।

অন্যদিকে আপনি যদি হটমেইল/আউটলুক, বিং, স্কাইড্রাইভ, ওয়াননোট, এক্সবক্স মিউজিকের ব্যবহারকারী হয়ে থাকেন, তাহলে স্বভাবতঃই মাইক্রোসফটের প্লাটফর্ম আপনার জন্য বেশি পছন্দনীয় হবে। যদিও এসব সেবার নিজস্ব বা অফিসিয়াল অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশনও রয়েছে।

লুমিয়া ৬২৫

অ্যাপ্লিকেশনের কথা আসায় বলতেই হয় যে, গুগল প্লে স্টোরে প্রচুর অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে। এতো বেশি যে, আপনার কাজের অ্যাপ্লিকেশনের পাশাপাশি একই কাজ করতে পারে এমন আরও হাজারটা অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে। বেছে নেয়ার জন্য অ্যাপসের কোনো অভাব নেই গুগল প্লে স্টোরে। অন্যদিকে উইন্ডোজ স্টোরেও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অ্যাপ্লিকেশন যোগ হতে থাকলেও আপনার এখনই প্রয়োজন এমন অনেক অ্যাপ্লিকেশন আবার মিস করতে পারেন মাইক্রোসফটের প্লাটফর্মে।

অ্যাপসের পাশাপাশি কাস্টোমাইজেশন অপশনও অ্যান্ড্রয়েডে তথা মটো জি-তে বেশি পাবেন। বুটলোডার আনলক, কাস্টম কার্নেল, কাস্টম রম ফ্ল্যাশ, কাস্টম লঞ্চার ইত্যাদি অনেক কিছুই আপনি মটো জি-তে করতে পারবেন যেখানে উইন্ডোজ ফোন তথা লুমিয়া ৬২৫-এ আপনি উইন্ডোজের একই লুক বা ইউজার ইন্টারফেসে আবদ্ধ থাকবেন।

সিদ্ধান্ত

আপনি যেহেতু এটি অ্যান্ড্রয়েড কথনে পড়ছেন, সেহেতু অনেকটা আন্দাজেই বলা যায় যে, ফোন কিনতে গেলে আপনার পছন্দ মটো জি-এর দিকেই থাকবে। সাধারণত লো-এন্ড অ্যান্ড্রয়েড ফোনের তুলনায় লো-এন্ড উইন্ডোজ ফোনের পারফরম্যান্স বেশি ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু মটো জি এই ধারণাকে বদলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। কেবল ডিসপ্লে-ই আপনাকে লুমিয়া ৬২৫ থেকে সরিয়ে মটো জি-এর দিকে নিয়ে যাবে। এছাড়াও ডিভাইসের লুক অ্যান্ড ফিল-ও আপনাকে মটো জি-এর দিকেই আকৃষ্ট করাবে বেশি।

তবে অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করতে করতে নতুন কিছু ব্যবহার করার ইচ্ছে থাকলে লুমিয়া ৬২৫-কে মোটেই খারাপ ডিভাইস বলা যাবে না। বরং আপনি উইন্ডোজ ফোন ৮-এর স্বাদ নিতে লুমিয়া ৬২৫ নিয়ে মাইক্রোসফটের প্লাটফর্মে আপনার যাত্রা শুরু করতে পারেন। তবে আপনি যদি অ্যাপস আর গেমস পাগল হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার যাত্রা খুব একটা শুভ হবে না, সে সতর্কবাণী আগে থেকেই দিয়ে রাখলাম!

মূল্য

মটোরোলা মটো জি: ১৭৯ ডলার

নকিয়া লুমিয়া ৬২৫: ২৩৯ ডলার

মন্তব্য

লুমিয়া ৬২৫ ও মটো জি থেকে বেছে নিতে হলে কোনটি বাছবেন এবং কেন? মন্তব্যের ঘরে জানান আপনার মতামত।