মাইক্রোসফটঃ অন্যকে নিন্দা করে নিজের সুনাম করা এক কোম্পানি

সম্প্রতি মাইক্রোসফট, নকিয়া এবং ওরাকলসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি মিলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে গুগলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। তাদের অভিযোগের বিষয়বস্তু, গুগল এবং অ্যান্ড্রয়েড। কোম্পানিগুলো দাবি করছে, গুগলের জনপ্রিয় মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম অ্যান্ড্রয়েড প্রতিযোগিতামূলক বাজারে গুগলের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে “অন্যায়ভাবে” বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে যার ফলে প্রতিযোগী কোম্পানিগুলো সুযোগ পাচ্ছে না। এছাড়াও গ্রুপের অভিযোগ, স্বল্পমূল্যে অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস ব্যবহারকারীর হাতে পৌঁছে দিতে গুগলের কার্যক্রমও অন্যান্য কোম্পানিগুলোর জন্য প্রতিযোগিতা কঠিন করে দিচ্ছে।

“ফেয়ারসার্চ ইউরোপ” নামধারী এই গ্রুপের অন্তর্গত কোম্পানিগুলো এক প্রেস রিলিজে জানিয়েছে, কোর অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমটি ফ্রি হলেও ডিভাইস প্রস্তুতকারকরা যখন গুগলের কোনো অ্যাপ্লিকেশনের লাইসেন্স নিতে চায়, তখন তাদের গুগল পুরো গুগল অ্যাপসের বান্ডল নিতে বাধ্য করে। অর্থাৎ, কোনো ডিভাইস প্রস্তুতকারক যদি কেবল গুগল ম্যাপস বা ইউটিউব বা গুগল প্লে স্টোরের লাইসেন্স নিতে চায়, তাহলে গুগলের নিয়মানুযায়ী তাকে পুরো গুগল অ্যাপসের বান্ডলটিই নিতে হবে এবং সেগুলোকে ডিভাইসের মেনুতে রাখতে হবে।

উল্লেখ্য, গুগল অ্যাপস বান্ডলে রয়েছে জিমেইল, ইউটিউব, গুগল ম্যাপস, গুগল প্লে স্টোর, গুগল টক ইত্যাদি।

অথচ গুগল সবগুলো অ্যাপ্লিকেশন ডিভাইসে দিয়ে দেয়ার জন্য বাধ্য করলেও সেগুলোকে ডিফল্ট হিসেবে সেট করার ব্যাপারে কোনো বাধ্য-বাধকতা রাখেনি। এছাড়াও অ্যান্ড্রয়েডে স্কিন ব্যবহার করা যায় বলে এইচটিসি তাদের সেন্স ও স্যামসাং তাদের টাচউইজ ইন্টারফেসের মাধ্যমে সহজেই গুগলের অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে ডিফল্ট অবস্থান থেকে সরিয়ে রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্যামসাং-এর বেশিরভাগ ডিভাইসেই ইমেইলের জন্য ডিফল্ট অ্যাপ্লিকেশন থাকে স্যামসাং-এর নিজস্ব ইমেইল অ্যাপ্লিকেশন। এখানে জিমেইল রাখতে বাধ্য হলেও তা ডিফল্ট হিসেবে রাখতে বাধ্য নয় কোনো কোম্পানিই।

অথচ ফেয়ারসার্চ নামের এই গ্রুপের আওতাধীন মাইক্রোসফট, নকিয়া আর ওরাকল দাবি করছে, গুগলের অ্যান্ড্রয়েড প্লাটফর্মের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে অনৈতিকভাবে ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছাচ্ছে। এই অ্যান্টি-ট্রাস্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইইউ কী জবাব দেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

আনপ্রফেশনাল মাইক্রোসফট

মাইক্রোসফট অনেকদিন ধরেই গুগলের সঙ্গে সরাসরি কেবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নয়, বরং নানা ভাবে গুগলের বিভিন্ন সেবা কীভাবে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা খর্ব করছে সে ব্যাপারে প্রচারণা চালিয়ে আসছে। গুগলের সেবাসমূহ নিয়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা খর্ব হওয়ার অভিযোগ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কাছ থেকেই রয়েছে। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠান কেবল ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিশ্চিত করার জন্যই গুগলের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় ও অভিযোগ দায়ের করে। অন্যদিকে মাইক্রোসফট তাদের প্রচারণার শেষাংশে তাদের সেবাগুলো যে কতো ভালো তা বলতে কখনোই ভুল করে না।

অন্য কথায়, মাইক্রোসফট বহুদিন ধরেই অন্যকে নিন্দা করে নিজেদের সেবার সুনাম করে আসা এক কোম্পানির নাম।

মাইক্রোসফট

ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে অ্যান্টি-ট্রাস্ট অভিযোগ দায়ের করার পরদিনই মাইক্রোসফট গুগলের প্লে স্টোরকে সরাসরি আক্রমণ করে একটি বিজ্ঞাপন টিভিতে, ইন্টারনেটে এবং প্রিন্টে প্রকাশ করেছে। কোম্পানিটির দাবি, যখনই কোনো ব্যবহারকারী প্লে স্টোর থেকে কোনো অ্যাপ্লিকেশন কেনেন, তখনই তার নাম, ইমেইল ঠিকানা ও অবস্থান সেই অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপারের কাছে পৌঁছে যায়। মাইক্রোসফটের স্টোর থেকে কোনো অ্যাপ্লিকেশন কিনলে সেই ক্রেতার কোনো তথ্যই ডেভেলপারের কাছে যায় না এই দাবির মধ্য দিয়ে বিজ্ঞাপনটি শেষ করেছে মাইক্রোসফট।

নিচের ভিডিওতে দেখুন মাইক্রোসফটের সমালোচিত সেই বিজ্ঞাপন।

প্রযুক্তি বিষয়ক প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় প্রকাশনা দি ভার্জ সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, মাইক্রোসফট এই মুহূর্তে সবচেয়ে সংকটময় সময় অতিক্রান্ত করছে। পুরো ডেস্কটপ কম্পিউটারের বাজার যখন নিম্নমুখী, মাইক্রোসফট তখন মোবাইল ও ট্যাবলেট জগতে তাল মিলিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছে। কেননা, তারা ভেবেছিল তারা সবসময়ই প্যাকেটে মুড়ে উইন্ডোজ আর মাইক্রোসফট অফিসের ডিভিডি বিক্রি করে যাবে। এখন পরিবর্তিত বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেই মাইক্রোসফট ক্লাউডভিত্তিক অফিস ও সাবস্ক্রিপশন-বেসড উইন্ডোজ সেবা আনার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

অন্য কথায়, মাইক্রোসফট ডেস্কটপ জগতের শীর্ষে থাকলেও আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর ক্ষেত্রে মাইক্রোসফট সবসময়ই এক স্টেপ পেছনে পড়ে ছিল। আর নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তির অভাব পড়ে যাওয়ায় তারা গুগলের মতো কোম্পানির বিরুদ্ধে শেমলেস মার্কেটিং-এ নেমেছে। ব্যবহারকারীর সুবিধার জন্য গুগলের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। বিনামূল্যে গুগল ডকস, প্রেজেন্টেশন, স্প্রেডশিট লাখ লাখ মানুষকে মাইক্রোসফটের অফিস সুট বাড়তি খরচ দিয়ে কেনা থেকে বাঁচিয়েছে। নিঃসন্দেহে মাইক্রোসফট অফিস পেশাদার কাজের জন্য অদ্বিতীয় সফটওয়্যার সুট, যেটি প্রাতিষ্ঠানিক কাজের জন্য দরকারী। কিন্তু ব্যক্তিগত কাজের জন্য গুগলের সেবাগুলো মাইক্রোসফট থেকে অনেকাংশেই সাশ্রয়ী ও সহজ।

গুগল ব্যবহারকারীদের সুবিধার কথা ভেবে শুরু থেকেই তাদের সেবাসমূহ ডিজাইন করে আসছে। আর মাইক্রোসফট গুগলের দেখাদেখি সেসব সেবার অনুরূপ করছে এবং গুগলকেই উল্টো বিভিন্ন অভিযোগে দুষছে। বিশ্বের এক নম্বর কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের এমন অপেশাদার আচরণে অনেক প্রযুক্তিবিদই হতাশা প্রকাশ করেছেন।

মাইক্রোসফটের এই গুগলবিরোধী কার্যক্রম নিয়ে আপনার কি মত?