অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে ব্যবহৃত সব সেন্সর এর কাজ (পর্ব-১)

আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি দেশের বাজারেও বর্তমানে নিত্য নতুন প্রযুক্তি পণ্যের সমাহার রয়েছে, রয়েছে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদাও। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন ও ট্যাবের চাহিদা সেই তালিকার শীর্ষে।

অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের অব্যাহত চাহিদার কথা চিন্তা করে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোও চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের পণ্যে নতুন নতুন প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটাতে। আর তারই প্রেক্ষিতে বর্তমানে স্মার্টফোন ও ট্যাবগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন সেন্সর, যাদের পত্যেকটির কাজও আলাদা।

আজ থেকে বিরতি দিয়ে ধারাবাহিকভাবে আপনাদেরকে জানাতে চেষ্টা করব অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন ও ট্যাবে ব্যবহৃত প্রায় সবরকম সেন্সরগুলোর নাম এবং তাদের কাজ সম্বন্ধে। তাহলে চলুন আজ শুরু করা যাক এর প্রথম পর্ব দিয়ে।

স্মার্টফোন জগতে সেন্সর এর প্রচলন আইফোন শুরু করলেও বর্তমানে স্যামসাং গ্যালাক্সি এস৪ কেই সেন্সর এর দিক দিয়ে আদর্শ একটি ডিভাইস ধরা হয়

১) অ্যাক্সেলেরোমিটার (Accelerometer)

অ্যাক্সেলেরোমিটার একটি হার্ডওয়্যার বেইজড সেন্সর। মূলত এটি মাইক্রো মেকানিকাল ডিভাইস, যেটি কোন বস্তুর অবস্থান, গতি প্রকৃতি, কম্পন, ত্বরণ ইত্যাদি পরিমাপ করতে ব্যবহার করা হয়। অ্যাক্সেলেরোমিটার এর মাঝে বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, যেমন: এক অক্ষ, দ্বি অক্ষ বা ত্রি অক্ষ বিশিষ্ট অ্যাক্সেলেরোমিটার।

অ্যাক্সেলেরোমিটার সেন্সর

অ্যাক্সেলেরোমিটারের এসব প্রকারভেদের মাঝে ত্রি অক্ষ বিশিষ্ট অ্যাক্সেলেরোমিটারই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। এটি খুব সহজেই ফোনের অরিয়েন্টেশন বুঝতে পারে। অর্থাৎ আপনার ফোনে অ্যাক্সেলেরোমিটার সেন্সর অন করে যদি আপনি আপনার ফোন কে কাৎ করে ‘ল্যান্ডস্কেপ’ অথবা ‘পোরট্রেইট’ করে ধরেন, তাহলে সেটি অনুযায়ী আপনার স্ক্রিনটি পরিবর্তিত হবে। অনেক সময় আমাদের ফোনের অরিয়েন্টেশন পরিবর্তন করার দরকার পরে। যেমন: ওয়েব ব্রাউজিং, ভিডিও দেখা, গেইম খেলা, বই পড়া বা টেক্সট পাঠানো। এসব ক্ষেত্রে ‘পোরট্রেইট’ মোড এর চেয়ে ‘ল্যান্ডস্কেপ’ মোড ব্যবহার করা বেশী আরামদায়ক। অ্যাক্সেলেরোমিটারের কল্যাণেই আমরা সহজে মোড সুইচ করতে পারি।

অ্যাক্সেলেরোমিটারের আরও কিছু জনপ্রিয় ব্যবহার রয়েছে। যেমন: মিউজিক প্লেয়ার কন্ট্রোল করা (শেক টু চেঞ্জ), গেইমিং এর সময় কি প্রেস না করে শুধু টিল্ট করে কন্ট্রোল করা, কিংবা বাটন প্রেস না করে শুধু ফ্লিপ করে রিঙ্গার অফ করা (ফ্লিপ টু মিউট) ইত্যাদি। মোট কথা, অ্যাক্সেলেরোমিটার আমাদের ফোনের অরিয়েন্টেশন কে বুঝতে পারে এবং সেটি পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন অরিয়েন্টেশনের সাথে ফোন কে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে।

 

২) অ্যাম্বিয়েন্ট লাইট সেন্সর (Ambient Light Sesnsor)

এটিও একটি হার্ডওয়্যার বেইজড সেন্সর। স্মার্টফোনে বা ট্যাবলেট পিসি তে সেন্সরটি ব্যবহার করা হয় এর ডিসপ্লে ব্রাইটনেস অ্যাডজাস্ট করার জন্য। এই সেন্সরটি তৈরি করতে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ফটো সেল, যেগুলো আলোককণার প্রতি সংবেদনশীল।

অ্যাম্বিয়েন্ট লাইট সেন্সর

আপনি যে পরিবেশে আছেন, সেন্সরটি সে পরিবেশের আলোর উপস্থিতি ধরতে পারে। যেমন আপনি যখন কোন অন্ধকার রুম বা বদ্ধ অন্ধকার পরিবেশে যাবেন তখন সেন্সরটি আপনার ডিসপ্লে ব্রাইটনেস কমিয়ে দিবে, কারণ অন্ধকারে হালকা ব্রাইটনেসেই স্পষ্ট দেখা সম্ভব। এতে করে আপনার ডিভাইসের ব্যাটারিও সাশ্রয় হবে।

আবার যখন আপনি কোন উজ্জ্বল আলোকময় পরিবেশে যাবেন, যেমন দিনের বেলায় বা সূর্যের আলোতে তখন এটি আপনার ডিভাইসের ডিসপ্লে ব্রাইটনেস বাড়িয়ে দিবে, কেননা সূর্যের আলোতে বা দিনের বেলায় আপনি অতিরিক্ত আলোর কারণে আপনার ডিসপ্লেটি ভালমত দেখতে পাবেন না। সূর্যের আলোতে স্পষ্টভাবে দেখতে আপনার অবশ্যই বেশি ব্রাইটনেসের প্রয়োজন হবে। যেসব স্মার্টফোনে অটো ব্রাইটনেস অপশন আছে, সেগুলো সবগুলোই অ্যাম্বিয়েন্ট লাইট সেন্সরের মাধ্যমে কাজ করে।

৩) প্রক্সিমিটি সেন্সর (Proximity Sensor)

প্রক্সিমিটি সেন্সর স্মার্টফোনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি সেন্সর। এটিও একটি হার্ডওয়্যার বেইজেড সেন্সর। এটি আপনার স্মার্টফোনের তুলনায় কোন বস্তু কত দূরে বা কাছে রয়েছে সেটি ডিটেক্ট করতে সক্ষম।

প্রক্সিমিটি সেন্সর

স্মার্টফোন থেকে আপনার শরীর কতদূরে রয়েছে এটি সেন্স করেই প্রক্সিমিটি সেন্সর বুঝতে পারে। আপনি যখন আপনার ফোন কানের কাছে নিয়ে যান তখন স্বয়ংক্রিয় ভাবেই ফোনের ডিসপ্লে লাইট অফ হয়ে যায় যাতে করে আপনার ব্যাটারি খরচ কম হয়। শুধু তাই নয়, এ সেন্সর অ্যাক্টিভ হবার ফলেই আপনি যখন ফোনে কথা বলেন তখন যদি আপনার ফোনের স্ক্রিনে অসাবধানতাবশত টাচ লেগে যায় তাহলে কোন সমস্যা হবে না।

সেন্সরসমূহের অবস্থান

অর্থাৎ আপনি যতক্ষণ কথা বলবেন ততক্ষণ এটি আপনার ফোনকে অপ্রয়োজনীয় কাজ করা থেকে রক্ষা করবে। আপনি কানের কাছ থেকে ফোনটি সরিয়ে নিলেই পুনরায় ডিসপ্লে লাইট ফিরে আসবে।

৪) কম্পাস/ ম্যাগনেটোমিটার / ম্যাগনেটিক সেন্সর (Compass / Magnetometer / Magnetic Sensor) 

কম্পাস সেন্সর

ম্যাগনেটিক সেন্সর

সহজভাবে বলতে গেলে কম্পাস বা ম্যাগনেটিক সেন্সর পৃথিবীর মেরুর সাথে সম্পর্কিত। সেন্সরটিতে একধরনের চুম্বক বা ম্যাগনেট ব্যবহার করা হয় যা পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা চুম্বক ক্ষেত্রের সাথে ক্রিয়া করে এবং পৃথিবীর সেই দিক কে নির্দেশ করে।

মূলত ন্যাভিগেশন এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলেও আজকাল স্মার্টফোনে বেশ ভালো ভাবেই ম্যাগনেটিক সেন্সর ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে স্বল্পদামী স্মার্টফোনগুলোতে এই সেন্সরটির ব্যবহার খুব বেশী লক্ষ্য করা যায় না। যেসব ফোনে নেভিগেশন ফিচারটি রয়েছে, কেবল সেসব ফোনেই এই সেন্সরটির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। মোট কথা, পৃথিবীর বিভিন্ন মেরুর সাথে তুলনা করে আপনার অবস্থান কোথায়, এটি দেখানই ম্যাগনেটিক সেন্সর এর কাজ।

অর্থাৎ স্মর্টফোন বা ট্যাবলেটের জিপিএস এর মাধ্যমে আমরা যে অবস্থান নির্ণয় করে থাকি, সেই কাজটি মূলত এই সেন্সটিই করে থাকে। অবস্থান নির্ণয় ছাড়াও বিভিন্ন গেম ও অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের কাজেও এই সেন্সরটি ব্যবহৃত হয়।

৫) জায়রোস্কোপ (Gyroscope)

কৌণিক ত্বরণের উপর ভিত্তি করে কোন কিছুর অবস্থান নির্ণয় বা পরিমাপ করার জন্য যে সেন্সর ব্যবহার করা হয় তাই জায়রোস্কোপ। অর্থাৎ স্মার্টফোনে ব্যবহৃত জায়রোস্কোপ প্রতিটি অক্ষের ঘূর্ণন গতি পরিমাপ করে থাকে।

অন্যভাবে বললে কোনো বস্তু কি হারে, কত দ্রুত কোনাকুনি ভাবে ঘুরবে সেটি নির্ণয় করা জায়রোস্কোপ এর কাজ। শুধু তাই নয়, অ্যাক্সেলেরোমিটার এবং জায়রোস্কোপ একত্রে ব্যবহারের ফলে একটি স্মার্টফোনে মোট ৬ টি অক্ষে মোশন সেন্স করতে পারে যা শুধুমাত্র অ্যাক্সেলেরোমিটারের তুলনায় কিছুটা বেশি সূক্ষ্ম ফলাফল দিতে সক্ষম।

স্মার্টফোনগুলোর মাঝে সর্বপ্রথম জায়রোস্কোপ আসে আইফোনের মাধ্যমেই

তবে ব্যায়বহুল হবার কারনে সব স্মার্টফোনে জায়রোস্কোপ দেয়া থাকে না। অপরদিকে এই সেন্সটি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণও নয়। একটু বেশি সূক্ষ্ম ফলাফল নির্ণয় করা ছাড়া এর তেমন কোন কাজ নেই। তাছাড়া অনেকের ধারণা জায়রোস্কোপ না থাকলে অ্যান্ড্রয়েড ৪.২ জেলি বিন এর ফটোস্ফিয়ার ক্যামেরা ব্যবহার করা যায়না। এই ধারণাটাও প্রকৃতপক্ষে ভুল। জায়রোস্কোপ থাকলেও আপনি আপনার সাধারণ অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে ফটোস্ফিয়ার ক্যামেরা ব্যবহার করতে পারবেন না। কারণ নেক্সাস ছাড়া আর কোন ডিভাইসে ফটোস্ফিয়ার নেই। তবে আপনি চাইলে জায়রোস্কোপ ছাড়াই নেক্সাস ক্যামেরা মড দিয়ে আপনার সাধারণ ফোনে ফটোস্ফিয়ার ক্যামেরা ব্যবহার করতে পারেন, শুধু ছবিগুলো নেক্সাস ডিভাইসগুলোর চেয়ে সামান্য কম কোয়ালিটির আসবে।

আমার জানা মতে অ্যাপলের আই ফোন ৪ ডিভাইসটিতেই সর্বপ্রথম বিল্ট ইন জায়রোস্কোপ দেয়া হয়। পরবর্তীতে নেক্সাস সিরিজের সব ডিভাইসেও জায়রোস্কোপ দেয়া হয়। বর্তমানে প্রায় সবরকম অ্যান্ড্রয়েড ফোনের পাশাপাশি দেশের বাজারে থাকা ওয়াল্টন ও সিম্ফনির বেশ কিছু ফোনেও জায়রোস্কোপ দেয়া হচ্ছে।

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন  ‘মোশন সেন্সর’ কোথায় গেল? আসলে মোশন সেন্সর কোন একক সেন্সর নয়। অ্যাক্সেলেরোমিটার সেন্সর, প্রক্সিমিটি সেন্সর, জায়রোস্কোপ সেন্সর এগুলো সবই মোশন সেন্সর।

এছাড়াও আরও অনেক সেন্সর রয়েছে, যেমন: থার্মাল সেন্সর, ব্যাক ইলুমিনেটেড সেন্সর ইত্যাদি। তবে এগুলোর প্রচলন আজকের পর্বের সেন্সরগুলোর মত এত বেশি নয়। তবে হতাশ হবার কিছুই নেই, পরবর্তী কিছু পর্বে এসব নিয়ে আবার বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ততদিন অ্যান্ড্রয়েড কথন ফেসবুক পেজ এর সাথেই থাকুন। আর এসব সেন্সর সম্পর্কিত যেকোন জিজ্ঞাসা, পরামর্শ কিংবা অনুরোধ থাকলে মন্তব্যের ঘরে তা আমাদের অবশ্যই জানাবেন।