স্যামসাং গ্যালাক্সি এস ৩ বনাম অ্যাপল আইফোন ৫

গ্যালাক্সি এস ৩ ও আইফোন ৫

অ্যাপল সম্প্রতি তাদের নতুন আইফোন ৫ ঘোষণা করলো। এর মধ্য দিয়ে বছরব্যাপী চলতে থাকা বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনার ইতি ঘটলো। তবে এই ঘোষণার আগেই অ্যান্ড্রয়েডের সঙ্গে বিশেষ করে স্যামসাং-এর সঙ্গে পেটেন্ট নিয়ে বেশ বড়সড়ো একটা যুদ্ধে জয়লাভ করে অ্যাপল। এরপর অ্যান্ড্রয়েডের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও থেমে থাকেনি অ্যান্ড্রয়েডের ও বিশেষ করে গ্যালাক্সি এস থ্রি’র অগ্রযাত্রা। বিশেষ করে অ্যান্ড্রয়েড জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী সেট হিসেবে খ্যাত গ্যালাক্সি এস ৩ এর উপর নিষেধাজ্ঞার আবেদন করা হলেও অনেকেই এখনও দ্বিধান্বিত এই নিয়ে যে, তাদের জন্য পারফেক্ট ফোন কোনটি হবে।

যারা এখনও স্মার্টফোন কেনেননি, তাদের সামনে গ্যালাক্সি এস ৩ ও আইফোন ৫ এর মধ্যে সাধারণ কিছু পার্থক্য তুলে ধরার লক্ষ্যেই আজকের এই পোস্ট।

ডিসপ্লে ও ডিজাইন

স্যামসাং গ্যালাক্সি এস ৩ হ্যান্ডসেটে রয়েছে ৪.৮ ইঞ্চি আকারের সুপার অ্যামোলেড এইচডি ডিসপ্লে যার পিক্সেল রেজুলেশন ১২৮০*৭২০ ও পিক্সেল পার ইঞ্চি (পিপিআই) ৩০২। তবে অনেকেই গ্যালাক্সি সিরিজের তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইলেও পেনটাইল ডিসপ্লে দেখে হতাশ হয়েছিলেন। প্রযুক্তিবিদদের আশা ছিল, স্যামসাং গ্যালাক্সি এস ৩ সেটে ট্রু আরজিবি ম্যাট্রিক্স-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি ডিসপ্লে দেবে। তবে স্যামসাং গ্যালাক্সি এস ৩ এর পাশাপাশি গ্যালাক্সি নোট ২-এও পেনটাইল ডিসপ্লে দিয়েছে। অবশ্য অনেকেরই মত, সাধারণ ভিউয়িং অ্যাঙ্গেলে এই দুই প্রযুক্তির ডিসপ্লের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য খালি চোখে ধরা পড়ে না। এছাড়াও এই স্ক্রিনে ৭২০পি এইচডি ভিডিও বেশ দারুণ দেখা যায় বলেও অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

অন্যদিকে অ্যাপলের নতুন আইফোনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনই হচ্ছে বড় আকারের ডিসপ্লে। এ পর্যন্ত অ্যাপলের সবগুলো আইফোনের ডিসপ্লের আকার ৩.৫ ইঞ্চি হলেও এবার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতেই বোধহয় অ্যাপল আইফোন ৫-এর ডিসপ্লের আকার বাড়িয়ে ৪ ইঞ্চি করেছে। তবে ডিসপ্লের প্রস্থ আগের আইফোনগুলোর মতোই রয়েছে। কেবল উপর-নিচ দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ, আইফোন ৪এস এর সঙ্গে আইফোন ৫ একসঙ্গে ধরলে আইফোন ৫ কে একটু লম্বা দেখাবে। পাশাপাশি হিসেবে সেট দু’টোর স্ক্রিনের আকার একই রয়েছে।

সে জন্যই আইফোন ৫-এর স্ক্রিন রেজুলেশন ১১৩৬*৬৪০ পিক্সেল ও ৩২৬ পিপিআই। ডিসপ্লের আকারের প্রস্থ আগের আইফোনের মতোই হওয়ায় আইফোন ৫ এর ভিজুয়াল এলিমেন্টে আলাদা কোনো পার্থক্য চোখে পড়বে না। যদিও স্ক্রিনের আকার আগের তুলনায় লম্বা হয়েছে, তবুও আপাতত বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করার সময় উপরে ও নিচে ৮৬টি ব্ল্যাক পিক্সেল থাকবে যা হয়তো অ্যাপ স্টোরের অ্যাপ্লিকেশনগুলোর পরবর্তী আপডেটে ঠিক করে ফেলা হবে। অন্যদিকে ৭২০পি এইচডি ভিডিও এই রেজুলেশনের ডিসপ্লের জন্য একটু বেশি হলেও আইফোন ৫-এর হার্ডওয়্যার সেই ভিডিওকে চালানোর জন্য যথেষ্টই শক্তিশালী।

আকার ও ওজনের দিক দিয়ে গ্যালাক্সি এস ৩ হচ্ছে 136.6 x 70.6 x 8.6 মিলিমিটার এবং ওজন ১৩৩ গ্রাম। অন্যদিকে অ্যাপল আইফোন ৫ হচ্ছে 123.8 x 58.5 x 7.6 এবং ওজন ১১২ গ্রাম।

মন্তব্যঃ আপনার যদি আকার কোনো সমস্যা না হয় ও আপনি যদি ৪.৮ ইঞ্চি আকারের ৭২০পি স্ক্রিন ও আর ভিভিড কালার পছন্দ করেন তাহলে গ্যালাক্সি এস ৩ আপনার জন্য। অন্যদিকে আপনার যদি পোর্টেবল, তুলনামূলক ছোট আকার ও হালকা ওজনের সেট পছন্দ করেন ও স্ক্রিন সাইজ ও রেজুলেশনে ছাড় দিতে রাজি থাকেন, তাহলে আইফোন ৫ হতে পারে আপনার ডিভাইস।

হার্ডওয়্যার

স্মার্টফোনে হার্ডওয়্যার বলতে সিপিইউ, জিপিইউ (গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট) ও র‌্যামকে ধরা হয়। গ্যালাক্সি এস থ্রি’র ক্ষেত্রে রয়েছে Exynos 4412 Quad SoC প্রসেসর যা মূলত ১.৪ গিগাহার্জ কোয়াড কোর প্রসেসর। পাশাপাশি গ্রাফিক্সের জন্য রয়েছে মালি ৪০০এমপি জিপিইউ। অবশ্য গ্যালাক্সি এস ৩ এর যুক্তরাষ্ট্রের সংস্করণ (এলটিই) -এ রয়েছে কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন এস ৪ প্রসেসর ও অ্যাড্রিনো ২২০ জিপিইউ। বেঞ্চমার্কের রেজাল্ট থেকে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের এলটিই সংস্করণের তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য তৈরি কোয়াড-কোর প্রসেসরের এস ৩ তুলনামূলকভাবে দ্রুত কাজ করে।

অন্যদিকে অ্যাপলের সদ্য ঘোষিত আইফোন ৫-এ রয়েছে A6 SoC প্রসেসর। যদিও এই প্রসেসর কোয়াড-কোর নয়, অ্যাপল দাবি করছে আইফোন ৪এস-এর ডুয়েল কোর প্রসেসরের তুলনায় এর গতি দ্বিগুণ হবে। একইসঙ্গে জিপিইউ-ও ৪এস-এর তুলনায় দ্বিগুণ পারফরম্যান্স দেবে বলে অ্যাপল দাবি করেছে। যদিও আইফোন ৫ বেঞ্চমার্ক টেস্টারদের হাতে আসার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না, তবুও অনেকেই মনে করছেন অ্যাপলের এই দাবি সত্য হতে পারে। এমনি এ৬ চিপটি নতুন আইপ্যাডে থাকা এ৫এক্স চিপের চেয়েও দ্রুতগতির হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

মন্তব্যঃ অ্যাপল ফ্যান নয়, বরং অ্যান্ড্রয়েড নিয়ে কাজ করেন এমন প্রযুক্তিবিদরাই খানিকটা হতাশার সঙ্গে বলেছেন যে, হার্ডওয়্যার ও গ্রাফিক্স পারফরম্যান্সের দিক দিয়ে আইফোন ৫ অ্যান্ড্রয়েডের যে কোনো ডিভাইসের চেয়ে বেশি ভালো পারফরম্যান্স দেবে। যদিও গ্যালাক্সি এস ৩ এর আন্তর্জাতিক সংস্করণের সঙ্গে আইফোন ৫-এর হার্ডওয়্যার অনেকটা কাছাকাছিই, তবুও মনে করা হচ্ছে পারফরম্যান্সের দিক দিয়ে আইফোনই এগিয়ে থাকবে। অবশ্য এ ব্যাপারটি প্রমাণ করার জন্য দরকার হবে আইফোন ৫-এর বেঞ্চমার্ক টেস্ট, যা আইফোন ৫ বাজারে আসার পরই পাওয়া যাবে।

স্টোরেজ স্পেস ও ক্যামেরা

অ্যাপল আইফোন আসবে ১৬, ৩২ ও ৬৪ গিগাবাইটের স্টোরেজে। ব্যবহারকারীরা এর চেয়ে বেশি স্টোরেজ আর কোনোভাবেই বাড়াতে পারবেন না। অন্যদিকে গ্যালাক্সি এস ৩ অধিকাংশ স্মার্টফোনের মতোই এসডি কার্ডের মাধ্যমে বাড়তি স্পেস যোগ করার সুবিধা দেয়। যাদের কাছে ফোনের স্টোরেজ স্পেস বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাদের জন্য গ্যালাক্সি এস ৩ তুলনামূলক কম দামে বেশি পছন্দ করার মতো ডিভাইস হতে পারে।

ক্যামেরার দিক দিয়েও দু’টি ডিভাইস প্রায় কাছাকাছি। যদিও অ্যাপলের আইফোন ক্যামেরাকে অন্যতম শক্তিশালী ক্যামেরা বলে ধরা হয়, কাগজে-কলমের হিসেবে দু’টোতেই রয়েছে ৮ মেগাপিক্সেল ব্যাক ক্যামেরা। তবে সামনের দিকের ক্যামেরার হিসেবে গ্যালাক্সি এস ৩ দিয়েছে ২ মেগাপিক্সেল ও আইফোন ৫ দিচ্ছে ৭২০পি এইচডি ক্যামেরা।

অপারেটিং সিস্টেম

সবাই জানেন যে, গ্যালাক্সি এস ৩ চলছে অ্যান্ড্রয়েড ৪.০ আইসক্রিম স্যান্ডউইচ অপারেটিং সিস্টেমে। এটি গুগলের তৈরি হলেও স্যামসাং ব্যবহারকারীদের ফ্রন্ট-এন্ড ইউজার ইন্টারফেস হিসেবে যোগ করেছে তাদের নিজস্ব টাচউইজ ইউআই। যদিও এটি অসাধারণ কোনো ইউজার ইন্টারফেস নয়, তবুও গ্যালাক্সি এস ও গ্যালাক্সি এস ২ এর তুলনায় গ্যালাক্সি এস ৩ এর ইন্টারফেস যথেষ্টই সুন্দর ও সহজ বলে মন্তব্য করেছেন রিভিউয়াররা।

এছাড়াও অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের বিভিন্ন সুবিধার সবই পাওয়া যাবে এস ৩-এ। যেমন সেট রুট করা, কাস্টম রম ইন্সটল করার মাধ্যমে পুরো ডিভাইসের লুক অ্যান্ড ফিল পরিবর্তন করে ফেলা ইত্যাদি। যদিও এর মাধ্যমে কখনো কখনো সেটের কিছু কিছু ফাংশন কাজ করা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে পারে (বাগ), তবুও এই ওপেননেসের ফলে ব্যবহারকারীরা একই ইউজার ইন্টারফেসে চিরদিন আটকে থাকবেন না।

যারা এসবে যেতে চান না তাদের জন্যও দ্রুতই অ্যান্ড্রয়েড ৪.১ জেলি বিন আপডেট আসছে বলে জানিয়েছে স্যামসাং।

অন্যদিকে অ্যাপল তাদের আইওএস ৬ অপারেটিং সিস্টেম আনবে আইফোন ৫-এর সঙ্গে। যদিও আইওএস ৬ বরাবরের মতোই একটি সম্পূর্ণ অপারেটিং সিস্টেম হবে এবং এতে প্রচুর অপটিমাইজড অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করার সুযোগ পাওয়া যাবে, ব্যবহারকারীরা আইফোনের চার দেয়ালেই আটকে থাকবেন। অর্থাৎ, চিরাচরিত “লকড” অপারেটিং সিস্টেমই থাকছে আইফোন ৫-এর সঙ্গে।

মন্তব্যঃ এখানেই আপনার পছন্দ নির্ভর করে। আপনি যদি উন্মুক্ত অপারেটিং সিস্টেম চান যার ইউজার ইন্টারফেস আপনি যখন-তখন পরিবর্তন করতে পারবেন, যার মেমোরি ম্যানেজমেন্ট, অ্যাপ্লিকেশন ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করতে পারবেন, তাহলে আমার মতোই অ্যান্ড্রয়েড তথা গ্যালাক্সি এস ৩ আপনার জন্য প্রযোজ্য। আর যদি লক ডাউন থাকার বিনিময়ে মসৃণ ও সাদাসিধে অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে অ্যাপলের আইওএস-এর ভক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে “বরাবরের মতোই” আইফোন ৫ আপনার পছন্দ হবে।

সবশেষে আপনার পছন্দ কোনদিকে গেল তা অবশ্যই মন্তব্যের ঘরে লিখে জানাবেন।