অ্যান্ড্রয়েডকে ফেসবুক ফোন বানাতে এলো ফেসবুক হোম

ফেসবুক হোম

শুরুটা হয়েছিল ২০১০ সালের দিকে। হঠাৎ করেই প্রযুক্তি বিশ্বে গুঞ্জন ওঠে, ফেসবুক তৈরি করবে নিজস্ব স্মার্টফোন। কমদামী সেই স্মার্টফোন পাল্লা দেবে আইফোন ও অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসের সঙ্গে। কিন্তু ফেসবুক আনুষ্ঠানিকভাবে সেই গুজবকে অস্বীকার করে এসেছে। চাপা পড়ে গেছে সব গুজব। বছর ঘুরে আবার ফেসবুক ফোনের গুজব রটেছে। আবারও প্রচুর ফেসবুক ফোনের ডিজাইন ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়েছে। কিছুদিন পর আবারও তা কেবল গুজব হয়েই মিলিয়ে গেছে।

কিন্তু ২০১৩-তে এসে সেই গুজব সত্যে পরিণত হলো। সত্যিই ফেসবুক আনু্ষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিলো ফেসবুক ফোনের। এমন একটি ফোন, যার হোমস্ক্রিন হবে আপনার ফেসবুকের নিউজফিড। যেই ফোন ব্যবহার করা মানে সারাক্ষণ ফেসবুকের বন্ধুদের সান্নিধ্যে থাকা। তবে না, এটি আলাদা কোনো অপারেটিং সিস্টেম নয়। এটি অ্যান্ড্রয়েডের জন্যই তৈরি ফেসবুকের একটি বিশেষ লঞ্চার যা আপনার ফোনকে পুরোপুরি ফেসবুক ফোনে পরিণত করে দিবে।

ফেসবুক হোম

“ফেসবুক হোম” হচ্ছে ফেসবুকের প্রথম ও নিজস্ব একটি অ্যান্ড্রয়েড হোম লঞ্চার। লঞ্চার মূলত বিশেষ এক ধরনের অ্যাপ্লিকেশন যেটি অ্যান্ড্রয়েডের পুরো আউটলুককেই বদলে দেয়। অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের অনেকেই জনপ্রিয় GoLauncher, Apex Launcher, Nova Launcher, Smart Launcher ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন বা এগুলোর সঙ্গে পরিচিত। এক কথায় বলা যায়, ফেসবুক হোমও তেমনই একটি বিশেষ ধরনের লঞ্চার।

অ্যাপস নয়, বন্ধুদের সামনে রাখুন

অন্যান্য লঞ্চার ব্যবহারের অন্যতম সুবিধা হলো আপনার পছন্দমতো আপনি বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন ড্রয়ার সাজাতে পারবেন, হোমস্ক্রিনে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি অ্যাপ্লিকেশন শর্টকার বা উইজেট রাখতে পারবেন কিংবা স্টাইলিশ কোনো ঘড়ি ও ওয়েদার উইজেট দিয়ে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারবেন আপনার অ্যান্ড্রয়েডের হোমস্ক্রিন। কিন্তু কখনও কি লক্ষ্য করেছেন, এসব লঞ্চার ব্যবহার করে আপনি নিজেকে আরও বেশি অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যেই আবদ্ধ করে ফেলছেন?

ফেসবুকের মতে, তাদের এই লঞ্চার “ফেসবুক হোম” আপনাকে সেই অ্যাপ্লিকেশনের গণ্ডি থেকে বের করে আপনাকে রাখবে আপনার ফেসবুক বন্ধুদের সান্নিধ্যে। কেননা, এই লঞ্চার ব্যবহার করলে আপনার হোমস্ক্রিনই রূপান্তরিত হবে ফেসবুক নিউজ ফিডে।

কভার ফিড

ফেসবুক হোম ব্যবহার করলে আপনার হোমস্ক্রিনের নাম হয়ে যাবে কভার ফিড। অর্থাৎ, আপনার হোমস্ক্রিনে আপনার বন্ধুদের সর্বশেষ আপলোড করা ছবি ও বিভিন্ন পোস্ট দেখতে পাবেন। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ গতকাল জানিয়েছেন, এসব ছবি বা পোস্টে দু’বার টাচ/ট্যাপ করে আপনি লাইক করতে পারবেন কিংবা একবার ট্যাপ করে মন্তব্য করতে পারবেন।

হ্যাঁ, ফেসবুক পোস্টে লাইক বা মন্তব্য করতে পারবেন একেবারে ফোনের হোমস্ক্রিন থেকেই! ফেসবুক অ্যাপ্লিকেশন চালু করার প্রয়োজন পড়বে না। কেনই বা পড়বে, আপনার ফোনই তখন হয়ে যাবে একটি ফেসবুক ফোন!

নোটিফিকেশন

ফেসবুকের বিভিন্ন নোটিফিকেশন আসবে আপনার হোমস্ক্রিনেই। আর অ্যান্ড্রয়েডের স্টক নোটিফিকেশন বারের মতোই আপনি সোয়াইপ করে একটি একটি করে নোটিফিকেশন মুছে দিতে পারবেন কিংবা সবগুলো একসঙ্গে সরিয়ে দিতে পারবেন। ফেসবুক ব্যতীত ডিভাইসের অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ট্রেডিশনাল নোটিফিকেশন বারও থাকছে জায়গামতোই। তাই ফেসবুক হোম ব্যবহার করলে অন্য নোটিফিকেশন হারিয়ে যাবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই।

গায়েব হচ্ছে না ট্রেডিশনাল নোটিফিকেশন বার।

তবে ফেসবুকের প্রথম ফোন “এইচটিসি ফার্স্ট”-এ সিস্টেম নোটিফিকেশনও ফেসবুক নিয়ন্ত্রণ করবে। এইচটিসি ফার্স্ট সম্পর্কে আরও তথ্য দেখুন এখানে

চ্যাট হেড ও মেসেঞ্জার

চ্যাট হেড নামটা একটু অদ্ভূত বটে! প্রযুক্তিবিদরাই এই নামকে “আজগুবি” বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে নাম যা-ই হোক, কাজে কিন্তু একেবারেই আজগুবি নয় এই চ্যাট হেড।

ফেসবুক হোম ব্যবহার করলে আপনার বন্ধুদের মেসেজ/ফেসবুক মেসেজ চলে আসবে হোমস্ক্রিনের উপরে। আর সেখানে কেবল তাদের প্রোফাইল পিকচারের একটি ছোট সংস্করণ (থাম্বনেইল) দেখাবে। একাধিক বন্ধুর সঙ্গে চ্যাট করার সময় একাধিক চ্যাট হেড হোমস্ক্রিনের/কভার ফিডের উপরেই থাকবে। আর আপনি বন্ধ না করার আগ পর্যন্ত সেগুলো সেখানেই থাকবে যাতে প্রয়োজনের সময় দ্রুত নেভিগেট করতে পারেন।

চ্যাট করার সময় অনস্ক্রিন কিবোর্ড হিসেবে দেয়া হয়েছে সুইফটকি-এর মতো দারুণ একটি কিবোর্ড। বলা প্রয়োজন, এই ফেসবুক মেসেঞ্জার কিন্তু কেবল ফেসবুক চ্যাটই নয়, বরং আপনার ডিভাইসের যাবতীয় এসএমএস বার্তাও নিয়ন্ত্রণ করবে!

অ্যাপ্লিকেশন লঞ্চার

মজার ব্যাপার হচ্ছে, উইন্ডোজ ৮-এ যেমন অনেকেই শাট ডাউন কীভাবে করে তা খুঁজে পান না, তেমনি ফেসবুক হোমে অনেকেই অ্যাপ্লিকেশন ড্রয়ার কীভাবে বের করে তা খুঁজে নাও পেতে পারেন। কেননা, এখন যেমন ডিভাইসের স্ক্রিনের নিচের দিকে চারকোণাকৃতির অ্যাপ্লিকেশন লঞ্চারে ক্লিক করে সব অ্যাপ্লিকেশনের তালিকা বের করেন, ফেসবুক হোম-এ তেমনটা পাবেন না।

তবে ফেসবুক হোম ব্যবহার করতে গেলে আপনার নিজের ছোট্ট একটি ছবি সবসময়ই চোখে পড়বে। আর সেই ছবিটি ড্র্যাগ করেই আপনাকে বিভিন্ন কাজ করতে হবে।

ফেসবুক জানিয়েছে, আপনার ছবিটি ড্র্যাগ করে উপরে নিলেই আসবে অ্যাপ্লিকেশন লঞ্চার। বাম দিকে নিলে আসবে ফেসবুক মেসেঞ্জার এবং ডান দিকে নিলে আসবে সর্বশেষ ব্যবহৃত অ্যাপ্লিকেশন। অর্থাৎ, ফেসবুক হোমের কল্যাণে প্রতিদিন আপনি অসংখ্যবার নিজের ছবিটি দেখতে ও ধরতে বাধ্য হবেন!

কবে, কখন, কোথায়

ফেসবুক হোম অ্যাপ্লিকেশনটি নির্দিষ্ট কিছু ডিভাইসের জন্য উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে স্যামসাং গ্যালাক্সি এস ৪, এইচটিসি ওয়ান ইত্যাদি। আগামী ১২ই এপ্রিল গুগল প্লে স্টোরে মুক্তি দেয়া হবে ফেসবুক হোম। তখনই আপনি দেখতে পারবেন এটি আপনার অ্যান্ড্রয়েড ফোনের জন্য উপযোগী কি না।

এই ফোনগুলোয় নিশ্চিত সাপোর্ট থাকছে ফেসবুক হোম-এর।

অবশ্য ট্যাবলেট ব্যবহারকারীদের জন্য আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। ফেসবুকের মতে, ট্যাবলেটের জন্য এখনও পুরোপুরি অপটিমাইজ করা হয়নি ফেসবুকের এই নতুন ঘর! তাই আরও কয়েক মাস পরই ফেসবুক হোম অ্যান্ড্রয়েড ট্যাবলেটের জন্য পাওয়া যাবে।

প্রথম ফেসবুক ফোন

ফেসবুক হোম একটি লঞ্চার। এই লঞ্চারটি ব্যবহার করা যাবে বিভিন্ন অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে। সনি, এইচটিসি ও স্যামসাং ফেসবুক হোম প্রোগ্রাম নামের একটি বিশেষ প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছে। অবশ্য এটি ফেসবুক ফোন তৈরি করার জন্য নাকি তাদের ডিভাইস ফেসবুক হোম লঞ্চারের জন্য উপযোগী করে তোলার লক্ষ্যে তা জানা যায়নি। তবে এতটুকু জানা গেছে যে, সত্যি সত্যই একটি ফেসবুক ফোন তৈরি করে ফেলেছে এইচটিসি।

এইচটিসি ফার্স্ট নামের এই অ্যান্ড্রয়েড ফোনটিতে বিল্ট-ইন থাকবে ফেসবুক হোম লঞ্চার। এছাড়াও মাত্র ৯৯ ডলারের এই ডিভাইসটির যাবতীয় নোটিফিকেশনও ব্যবস্থাপনা করবে ফেসবুক হোম লঞ্চার। এইচটিসি ফার্স্ট সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন এই পোস্টে

অপছন্দের কারণ

ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ একগাল হেসে জানিয়েছেন, “কভার ফিডে এখনই না হলেও আগামীতে বিজ্ঞাপন আসবে।”

ফেসবুক হোম এখনও কেউ ব্যবহার করেননি। অন্তত সাধারণ ব্যবহারকারীরা তো নয়ই। অথচ এরই মধ্যে ফেসবুক হোমকে “না” বলে দিয়েছেন অনেক পাঠক।

প্রথমতঃ ফেসবুক হোম লঞ্চারে আপনি কোনো অ্যাপ্লিকেশন শর্টকাট বা উইজেট রাখতে পারবেন না। আমাদের অনেকেরই অ্যান্ড্রয়েড প্রথম পছন্দ এর বিভিন্ন উইজেটের জন্য। এছাড়াও দৈনিক বারবার চালু করা হয় এমন অ্যাপ্লিকেশনের শর্টকাট হোমস্ক্রিনে রাখাও বেশ কাজে আসে। কিন্তু ফেসবুক হোম ব্যবহার করলে আপনি পুরোপুরিই বঞ্চিত হবেন সেই সুবিধা থেকে।

স্মার্ট লঞ্চার নামের একটি লঞ্চারেও এই অসুবিধা রয়েছে কিন্তু তবুও সেটি জনপ্রিয়। কেননা, স্মার্ট লঞ্চারে উইজেট না রাখা গেলেও হোমস্ক্রিনে অ্যাপ্লিকেশন শর্টকাট রাখা যায়। ফেসবুক হোমে যেটা আপনি পারবেন না।

দ্বিতীয়তঃ ফেসবুক হোমের কভার ফিডের কারণে আপনার ইন্টারনেট আগের চেয়ে দ্বিগুণ খরচ হতে থাকবে। অনেকের জন্যই এটা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু সিলিকন ভ্যালি কিংবা মাউন্টেইন ভিউতে যেটা কোনো ব্যাপার না, অনেক মিতব্যয়ী ব্যবহারকারীর কাছেই সেটা অনেক বড় ব্যাপার। এছাড়াও সারাক্ষণ ডেটা টানতে থাকার কারণে দ্রুতই ব্যাটারি শেষ হয়ে যাবে যা ফেসবুক হোম পছন্দ না করার আরেকটি কারণ হতে পারে।

তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ একগাল হেসে জানিয়েছেন, কভার ফিডে এখনই না হলেও আগামীতে বিজ্ঞাপন আসবে। অর্থাৎ, যখন ফেসবুক এই ফেসবুক হোম থেকে টাকা আয়ের চিন্তা শুরু করবে, তখন থেকে আপনি আপনার হোমস্ক্রিনে বিজ্ঞাপন দেখতে শুরু করবেন!

কেবল এই শেষের কারণটিই ফেসবুক হোমের জনপ্রিয়তা কিংবা সম্ভাব্য ব্যবহারকারীদের দূরে ঠেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট বলে মনে করছেন অনেক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।

আপনার মন্তব্য

এইচটিসি ফার্স্টের অন্যতম অসুবিধা হচ্ছে (সম্ভবত) সেটায় আপনি ফেসবুক হোম বাদ দিতে পারবেন না। যখন বিজ্ঞাপন দেখানো শুরু করবে ফেসবুক, তখন তাই দেখতে হবে। কিন্তু অন্যান্য অ্যান্ড্রয়েড ফোনে পছন্দ না হলেই ফেলে দিতে পারবেন ফেসবুক হোম। কিন্তু এই রিভিউতে যা যা জানলেন, এইসব সুবিধা ও অসুবিধা বিবেচনা করে ফেসবুক হোম কি আপনার অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে “স্থায়ীভাবে” ব্যবহার করবেন?

আরও পড়ুন