হ্যান্ডস-অন রিভিউঃ Ainol Novo 7 Venus ট্যাব

novo 7 venus

ট্যাবের বাজারে অনেকদিন ধরেই চাইনিজ প্রতিষ্ঠান আইনলের চাহিদা প্রচুর। স্যামসাং গালাক্সি ট্যাব, এইচটিসি ফ্লাইয়ার, আসুস ট্রান্সফরমার ও মটোরোলা জুম এর সাথে পাল্লা দিয়ে আইনলের ট্যাবগুলো বাজার দখল করতে থাকে শুধুমাত্র তাদের স্বল্পমূল্যে সর্বাধিক ক্ষমতাশালী হার্ডওয়্যার ব্যবহারের কারণে। নন-ব্র্যান্ডেড বলবো না, কিন্তু স্বল্প পরিচিত ব্র্যান্ড বলা যেতেই পারে আজ আইনলকে। আইনলের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের ফার্মওয়্যার সম্পূর্ণ ওপেন সোর্স। আর এর জনপ্রিয়তার কারণে আইনল ট্যাবগুলোর প্রচুর কমিউনিটি সাপোর্ট রয়েছে। অর্থাৎ, আপনার যে কোনও জিজ্ঞাসা বা সমস্যার সমাধান বা নতুন আপডেট পেতে কখনোই সমস্যা হবেনা আইনলে।

আর আইনল আর সব চাইনিজ কোম্পানির মতো অ্যান্ড্রয়েড ভার্সন আপডেট করতেও দেরি করেনা। অনেকটা নেক্সাস ডিভাইস এর মতোই সর্বশেষ আপডেটের স্বাদ পাওয়া যায় বেশ দ্রুত।

আইনলের গুণগান অনেক করলাম, এবার আসল কথায় আসা যাক। আগের মডেলগুলো যেমন এলফ ২, ফ্লেম বা অরোরা ২ প্রায় নিখুঁত ছিল, এবার সম্প্রতি বাজারে আসা কোয়াড-কোর ট্যাবলেট আইনল নভো ৭ ভেনাসের দিকে নজর দেয়া যাক।

Ainol Novo 7 Venus

নভো ৭ ভেনাস

নভো ৭ ভেনাস আইনলের সর্বশেষ ৭ ইঞ্চি ট্যাবলেট, যা আইনল মূলত ক্রিস্টালের পরবর্তী সংস্করণ হিসেবে বাজারে এনেছে। কিন্তু আগে যেমন এলফ ২ বা আরোরা ২ এর সাথে ক্রিস্টালের তেমন পার্থক্য ছিলনা, এবারে তার পুরোপুরি উল্টোটা দেখা যাচ্ছে। ভেনাসে ব্যবহার করা হয়েছে কোয়াড-কোর ACT-ATM7029 প্রসেসর, যা এমনিতে ১.০৮ গিগাহার্জে ক্লক করা থাকে। সাথে থাকছে ভিভান্তে GC1000 জিপিইউ, যা আগের কোনও ট্যাবেই আইনল ব্যবহার করেনি। ক্রিস্টালের প্রায় সমান দামেই আইনল ভেনাসে কোয়াড কোর প্রসেসর দিচ্ছে, যা অনেকটাই চমকপ্রদ। এ ছাড়াও এর পেছনে ক্যামেরা রয়েছে, যা আগের আইনল ৭ ইঞ্চি কোনো ট্যাবেই ছিল না।

ডিজাইন

নভো ৭ ভেনাস

এক কথায় ভেনাসের ডিজাইন নজর ব্যবহারকারীদের কাড়তে সক্ষম। যদিও পুরোটাই প্লাস্টিকের তৈরি, ধরে বা ব্যবহার করে আমাদের কাছে খুবই উন্নত মানের মনে হয়েছে। সামনের পর্দা ও তার পাশের পাঁড় ঝকঝকে প্লাস্টিকের হলেও পেছনটা ম্যাট ও গ্রিপ যুক্ত, যা অনেকটাই আমাদের গুগল নেক্সাস ৭ এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। অবশ্য আইনলও একটি চাইনিজ কোম্পানি, তারা অনেক সময়ই বিখ্যাত ব্রান্ডের ডিজাইন নকল করেই থাকে। যেহেতু পেছনটা ম্যাট ও ডিম্পল (ক্ষুদ্র ফুটো) যুক্ত, তাই এটি হাতে একদমই পিছলায় না। ওজনেও হাল্কা হবার ফলে দীর্ঘ সময় ব্যবহার করতে কোনও সমস্যা হয়না।

পাশে এটিতে চার্জার পোর্ট, মাইক্রো ইউএসবি পোর্ট, মাইক্রো এইচডিএমআই পোর্ট, মাইক্রো এসডি স্লট ও হেডফোন জ্যাক রয়েছে। ট্যাবটি পেছনের দিকে ঢাল হয়ে নেমে যাবার কারনে অন্যান্য ট্যাবের তুলনায় দেখতে ছোট লাগে, কিন্তু মাপ অনুযায়ী এটি অন্যান্য ৭ ইঞ্চি ট্যাবের সমান, আর পাশাপাশি আরেকটু বড়।

সবমিলিয়ে আইনল নভো ৭ ক্রিস্টাল বা এলফ ২-এর চেয়েও ডিজাইনের দিক দিয়ে অনেক বেশি এগিয়ে আছে আইনল নভো ৭ ভেনাস।

ডিসপ্লে

নভে ৭ ভেনাস

ভেনাসের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর ডিসপ্লে। এটিতে আইপিএস প্রযুক্তির ডিসপ্লে ব্যবহার করেছে আইনল, যা আমাদের দেখা অন্যান্য ৭ ইঞ্চি ডিসপ্লের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জ্বল ও খুবই শার্প এবং নিখুঁত। এর রেজুলেশন ১২৮০ বাই ৮০০ পিক্সেল যা ৭ ইঞ্চির ট্যাবলেটের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না। রেজুলেশন ও ভালো ব্রাইটনেসের সংমিশ্রণে ভেনাস ট্যাবটি মুভি দেখা, বই পড়া বা ওয়েব ব্রাউজিং ইত্যাদি সব কিছুরই একদম খুঁটিনাটি জিনিসও খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম। আর আইপিএস প্রযুক্তির কল্যাণে যে কোনও কোণ থেকেই স্পষ্ট ভাবে সব কিছু দেখা সম্ভব।

রেজুলেশন আর ডিসপ্লের উজ্জ্বলতা ছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার টাচ রেসপন্স। খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ভেনাসের টাচ প্যানেল আইনল আগের থেকে উন্নত করেছে (টাচের রেসপন্ড করার ক্যাপাসিটিভ সেলগুলো আগের থেকে ছোট), যার ফলাফল আরও নিখুঁত টাচ রেসপন্স, খুব হাল্কা এবং ছোট ছোঁয়াতেও ভেনাস দ্রুত রেসপন্ড করে।

সাউন্ড

নভে ৭ ভেনাস

সাধারণত আমরা সাউন্ড কোয়ালিটি নিয়ে তেমন কিছু বলিনা, কিন্তু ভেনাসের ব্যাপারে বলা উচিৎ। ভেনাসের স্পিকার সাউন্ড বেশ জোরালো, সাধারণত ট্যাবে এতোটা হয় না। হেডফোন বা স্পিকার দু’টোতেই সাউন্ড বেশ স্পষ্ট। ফলে গান শোনা, মিউজিক ভিডিও দেখা বা মুভি দেখা কিংবা অডিও/ভিডিও কল করার ক্ষেত্রে সহায়ক। অবশ্য এতে স্পিকার একটি তাই স্পিকারে স্টেরিও সাউন্ড পাবেন না।

সিপিউ, জিপিইউ এবং গেমস

নভো ৭ ভেনাস

ভেনাসের সিপিউ এবং জিপিইউ নিয়ে একটু দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন, একটু ধৈর্য্য নিয়ে পড়ুন। ভেনাসের সিপিউ কোয়াড কোর সেটি আগেই বলেছি। কিন্তু কোয়াড কোর দিয়েই সবকিছু বিচার করা সম্ভব না। এমনি ত যদি বলতে হয়ে তবে Actions ACT-ATM7029 প্রসেসরটি ARMv7 NEON সাপোর্ট করে যা অনায়াসে আধুনিক সব প্রোগ্রাম ও গেম লোড করতে সক্ষম। ওয়েব ব্রাউজিং, ১০৮০পি এইচডি মুভি প্লে করা বা অন্যান্য কোনো কাজেই স্লো পারফরম্যান্স বা ল্যাগ পাবেন না। ১.০৮ গিগাহার্জে ক্লক করার কারনে খুব একটা গরমও হবে না ট্যাবটি। আমরা দীর্ঘ সময় নিয়ে চালিয়ে দেখেছি।

কিন্তু এই প্রসেসরের কিছু তথ্যে ভুল আছে। প্রথমত এটি কর্টেক্স এ৫ ঘরানার, আইনলের দাবি করা এ৯ নয়। অর্থাৎ, আমরা করটেক্স এ৯ কোয়াড কোরের কাছ থেকে যেরূপ পারফর্মেন্স আশা করব এটি তা দিতে পারবে না; এবং দিচ্ছেও না। কিন্তু তাই বলে হতাশ হবেন না, পার্থক্য আকাশ পাতাল নয়, বেঞ্চমার্কেই দেখতে পাবেন। কিন্তু আপনি যদি হাই রেজুলেশন গেম যেমন রিয়েল রেসিং ৩ খেলতে চান, ভেনাস আপনার জন্যে নয়।

নভো ৭ ভেনাস

সিপিউই শেষ কথা নয়, জিপিইউও একটি জরুরী বিষয়। ভেনাসে ব্যবহার করা হয়েছে ভিভান্তে জিসি১০০০এম্পি জিপিইউ। যারা যারা আমাদের সাথে আছেন অনেকদিন হলো, তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এটি একদমই নতুন এবং বিরল জিপিইউ, তাই এটিই ভেনাসের মুল দুর্বলতা যা কিছু কিছু গেমিং-এ খুবই খারাপ পারফরম্যান্স দিতে পারে। যেমন উপরের ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন নিড ফর স্পিড মোস্ট ওয়ান্টেডে অকারণেই গাড়ির কাঁচ ভাঙা দেখাচ্ছে। (না, আমরা কাঁচ ভেঙে ফেলিনি!)

জিসি১০০০এম্পি জিপিইউটি নরমাল বেঞ্চমার্ক ও মুভি চালানোতে ভাল পারফর্মেন্স দিয়েছে। ১০৮০পি ভিডিও ল্যাগ ছাড়াই চালাতে সক্ষম, শুধু ৭ ইঞ্চি পর্দায়ই নয় এইচডিএমআই এর মাধ্যমে আরও বেশি রেজুলেশনেও দেখাতে সক্ষম। কিন্তু সমস্যা একটিই, বেশিরভাগ গেমই এই জিপিইউ মডেল লক্ষ্য করে বানানো নয় ফলে চলতে সমস্যা করে। খুবই দুঃখের বিষয় এটি। টেকনিক্যাল কম্পারিসন বেঞ্চমার্কে থাকছে। কিন্তু তারপরও ভেনাস এর গেমিং পারফরম্যান্স অতোটা খারাপ না। কিছু গেম যেমন Dead Trigger- Smoothly চলে; আবার কিছু গেম যেমন GTA:Vice City , GTA III প্রচণ্ড আটকায় বা Lag করে!

সারমর্মঃ ফুল গেমিং ট্যাব নয় আইনল নভো ৭ ভেনাস।

ইউএসবি

একটি সম্পূর্ণ নতুন অংশই খুললাম আপনাদের জানার আগ্রহ দেখে! ভেনাসে ইউএসবি মাস স্টোরেজ মোড ও ওটিজি সাপোর্ট আছে। ফলে পেনড্রাইভ, কিবোর্ড বা মাউস কোনো ঝামেলা ছাড়াই কাজ করে।

ক্যামেরা

সাধারণত ট্যাব-এ ভাল ক্যামেরা থাকে না। ভেনাস-এও ব্যতিক্রম না। এতে রয়েছে ১.৯ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা (Back) এবং ভিডিও কল করার জন্য সামনে থাকছে ০.৩ মেগাপিক্সেল এর ক্যামেরা। ক্যামেরা Quality দেখে আমরা আসলেই অসন্তুষ্ট। নিচে থাকল কিছু ক্যামেরা দিয়ে তোলা ছবি।

সফটওয়্যার ও ইউজার ইন্টারফেস

আইনল নভো ৭ ভেনাসে চলছে স্টক অ্যান্ড্রয়েড ইউজার ইন্টারফেস। কাজেই বুঝতেই পারছেন এতে বিশেষ কিছু নেই। অ্যান্ড্রয়েড ৪.১ জেলিবিনের সব ভার্সনের মতোই এতে রয়েছে ট্যাবলেট ইউজার ইন্টারফেস। তাছাড়া নিচে নেভিগেশন বারে তারা স্ক্রিনশটের জন্য বিল্ট ইন অ্যাপ এর বাটন রেখে দিয়েছে, ফলে স্ক্রিনশট নিতে আর আলাদাভাবে কোন অ্যাপ্লিকেশন ইন্সটলের ঝামেলায় যেতে হবে না। যখন খুশি তখন নেভিগেশন বারের স্ক্রিনশট আইকন থেকেই স্ক্রিনশট নিতে পারবেন। এই ব্যাপারটি অনেক ব্যবহারকারীরই পছন্দ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

নভো ৭ ভেনাস

নভো ৭ ভেনাস

বেঞ্চমার্ক

এবার আসা যাক বেঞ্চমার্কের দিকে। অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস কেনার পরপরই পরীক্ষার জন্য সবাই মূলত Antutu Benchmark ই প্রথমে ইন্সটল করে থাকে। প্রথমে Antutu Benchmark স্কোরেরই এর স্ক্রিনশট।এবং আরেকটি মজা বিষয় হচ্ছে এটির Benchmark স্কোর। দেখে অবাক হবেন যে এটি Antutu Benchmark এ মোট ১২৩৪৫ এর  স্কোর পেয়েছে!

নভো ৭ ভেনাস

তাছাড়াও আমরা সাধারণত Quadrent Benchmark দিয়েও ডিভাইস টেস্ট করি। Quadrent এ ভেনাস এর স্কোর এসেছে ২৬২০ যা প্রায় স্যামসাং গ্যালাক্সি ট্যাব ১০.১-এর সমান!

নভো ৭ ভেনাস

এছাড়া Nenamark 2-তে ভেনাস ৪৮.৮ এফপিএস পেয়েছে। যেটি আসুস ট্রান্সফরমার প্যাড-কেও ছাড়িয়ে গেছে।

নভো ৭ ভেনাস

সমস্যা

কোন ট্যাবই একদম পারফেক্ট হতে পারে না। কিছু না কিছু সমস্যা থাকেই। বরাবরের মত এই ট্যাবটিতেও কিছু সমস্যা পেয়েছি তবে সেটা খুবই সামান্য। প্রথমেই বলেছি জিপিইউ সংক্রান্ত সমস্যার কথা যার ফলে গেমিং-এ সন্তুষ্ট নাও হতে পারেন আপনি। একই সঙ্গে স্বল্প-পরিচিত জিপিইউ দেয়ার কারণে গুগল ক্রোম ব্রাউজারও ব্যবহার করা যায় না।

এছাড়াও ট্যাবটিতে ব্লুটুথ, জিপিএস এবং সিম স্লট নেই। তবে এগুলো তেমন সমস্যা বলা চলে না কারণ শুধু ওয়াইফাই ট্যাবগুলোতে এসব এমনিতেও থাকে না।

এছাড়াও ভেনাসের স্পিকারটিও একপাশে দেয়া হয়েছে। ফলে গেমিং এর সময় হাত লেগে আওয়াজ আটকে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এই সমস্যাটার একটি সমাধানও রয়েছে। যেহেতু অটো রোটেশন আছে তাই অন্য দিকে ঘুরিয়ে গেম খেললে আর স্পিকারের উপর হাত লাগার সম্ভাবনা নেই।

সিদ্ধান্ত

ট্যাব কেনার সিদ্ধান্তের সময় প্রথমেই যেটা মাথায় আসে সেটি হলো এর দাম। ঢাকার গ্যাজেট গ্যাং ৭ অ্যান্ড্রয়েড কথনকে জানিয়েছে, বর্তমানে তারা আইনল নভো ৭ ভেনাস ট্যাবটি বিক্রি করছে ১৭,৭০০ টাকায়।

সবগুলো হ্যান্ডস-অন রিভিউতেই আমরা চেষ্টা করি ডিভাইসগুলোর প্রায় সবকিছুই তুলে ধরতে। এই ট্যাবটির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। তারপরও যদি কিছু বাদ পড়ে থাকে কিংবা আরও কিছু যদি জানতে চান তাহলে মন্তব্যের ঘরে আমাদের জানাতে পারেন। পুরো রিভিউ দেখার পর ট্যাবটি কিনবেন কি কিনবেন না সেই সিদ্ধান্ত জানাতেও ভুলবেন না।

হ্যান্ডস-অন রিভিউটিতে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন অ্যান্ড্রয়েড কথনের সিনিয়র টেকনিক্যাল এক্সিকিউটিভ এস এম তাহমিদ