হ্যান্ডস-অন রিভিউঃ টেলিটক ৩জি ও ফ্ল্যাশ মডেম

teletalk-3g-mobile

অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রতীক্ষার পর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ৩জি ইন্টারনেট সেবা চালু করে টেলিটক। প্রথম যখন টেলিটকের সিম বাজারে ছাড়া হয়, তখন যেমন ব্যাপক চাহিদা ও ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে, ধারণা করা হচ্ছিল টেলিটক ৩জি সিম বাজারে আসার পরও এমনি ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যাবে টেলিটকের আউটলেটগুলোর সামনে।

কিন্তু তেমনটা তো হয়ইনি, বরং উল্টো ৩জি সিম বিক্রি করতে টেলিটককে প্রচারণায় প্রচুর ব্যয় করতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষের আগ্রহের শেষ নেই, কিন্তু নামটা যখন “টেলিটক,” যাদের মোবাইল নেটওয়ার্কই সবখানে ঠিকভাবে পাওয়া যায় না, তাদের ৩জি নেটওয়ার্ক আসলে কেমন হবে এই দ্বিধাদ্বন্দ্বই হয়তো ক্রেতা আকৃষ্ট না হওয়ার মূল কারণ।

৩জি ইন্টারনেটের সুবিধা পেতে হলে ব্যবহারকারীকে অবশ্যই ৩জি সুবিধা-সম্বলিত হ্যান্ডসেটের প্রয়োজন হবে। নকিয়ার ৩জি সুবিধা-সম্পন্ন কিছু কমদামী সেট থাকলেও সেগুলোর ইন্টারনেটের গতি খুবই কম। অর্থাৎ, ৩জি ব্যবহার করতে হলে ব্যবহারকারীকে স্মার্টফোনের দ্বারস্থ হতে হবে। আর সাধারণ মানুষের জন্য স্মার্টফোন মানেই অ্যান্ড্রয়েড। উইন্ডোজ ফোন চালিত নকিয়া লুমিয়া কিংবা অ্যাপল আইফোন সাধারণ মানুষের নাগালের অনেক বাইরে। এছাড়াও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার বিষয় বিবেচনা করলেও অ্যান্ড্রয়েড ফোনই ৩জি ইন্টারনেট ব্যবহারে ইচ্ছুক ক্রেতার একমাত্র উপায়। তাই আমরা অ্যান্ড্রয়েড কথন টিম আজ প্রকাশ করছি টেলিটক ৩জি ও ফ্ল্যাশ মডেমের হ্যান্ডস-অন রিভিউ।

Teletalk 3G

প্রথমেই জানিয়ে নেই আমাদের ব্যবহৃত ইউনিট সম্পর্কিত তথ্য। টেলিটকের পুরনো ২জি সিমগুলোকেও ৩জিতে রূপান্তর করা যায় নির্দিষ্ট ফি দেয়ার বিনিময়ে। সে তথ্য হয়তো সবাই জানেন। কিন্তু আমাদের ইউনিট ছিল সম্পূর্ণ নতুন টেলিটক ৩জি সিম ও ফ্ল্যাশ মডেমের বান্ডল। স্মার্টফোন এক্সপো ২০১৩-তে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে বিনামূল্যে টেলিটক ৩জি সিম দেয়া হয়, যাদের মধ্যে অ্যান্ড্রয়েড কথন ছিল।

টেলিটক ৩জি সিমটি আমরা সঙ্গে দেয়া ফ্ল্যাশ মডেমের পাশাপাশি ৩জি ইন্টারনেট সুবিধাসম্পন্ন অ্যান্ড্রয়েড ফোন সনি এরিকসন এক্সপেরিয়া মিনি প্রো-তে ব্যবহার করেছি। এতে করে মোবাইলে ব্যবহারকারীরা কী রকম অভিজ্ঞতা পাবেন তাও ধারণা করা সম্ভব হয়েছে। তো চলুন দেখে নেয়া যাক আসলেই কেমন পারফরম্যান্স দিচ্ছে টেলিটক ৩জি।

Teletalk 3G Flash Modem

টেলিটক ৩জি ফ্ল্যাশ মডেমের দাম ২,৫০০ টাকা, সঙ্গে থাকছে ৩জি সিম। কেনার সময় স্বাভাবিক সিম কেনার মতোই রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হবে। আর সঙ্গে ১০ দিনের মেয়াদে পাবেন ফ্রি ১০ গিগাবাইট ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ।

যেহেতু আমরা ফ্ল্যাশ মডেমের মাধ্যমেই টেলিটক ৩জি প্রথমে ব্যবহার করেছি, তাই আগে এই মডেম সম্পর্কেই কিছু বলে নেয়া ভালো। টেলিটক ৩জি ফ্ল্যাশ মডেমটির আসল প্রস্তুতকারক চাইনিজ প্রতিষ্ঠান জেডটিই। এটি মূলত একটি ইউএসবি প্লাগ-অ্যান্ড-প্লে মডেম যা যে কোনো অপারেটিং সিস্টেমে কাজ করে। অবশ্য আমরা টেস্টিং-এর সময় লিনাক্স-ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেমগুলোতে প্লাগ-অ্যান্ড-প্লে পদ্ধতিতে সংযোগ দিতে পারিনি। তবে উইন্ডোজ এক্সপি সার্ভিস প্যাক ২ এবং উইন্ডোজ ৭-এ সরাসরিই ইন্সটল করা গেছে এই মডেমের সফটওয়্যার।

ম্যাক ব্যবহারকারীদের জন্য ওএস এক্স ১০.৪ বা এর পরবর্তী সংস্করণগুলো সাপোর্ট করবে বলে লেখা রয়েছে। মডেমের বক্সেই এ সংক্রান্ত তথ্য, ইউজার গাইড ও টেলিটক ফ্ল্যাশ মডেমের ওয়ারেন্টি কার্ড রয়েছে। কেনার সময় সেটা পূরণ করিয়ে নিতে ভুল করবেন না।

teletalk 3g flash modem

টেলিটক ৩জি ফ্ল্যাশ মডেম।

যারা ইতোমধ্যেই গ্রামীণফোন বা সিটিসেল জুম-এর কোনো মডেম ব্যবহার করেছেন, তাদের জন্য মডেম সফটওয়্যারের ইন্টারফেস বেশ চেনা-পরিচিতই মনে হবে। কেননা, এগুলো সবগুলোর কাজ প্রায় একই রকম। প্রথম স্ক্রিন থেকে ইন্টারনেটে কানেক্ট-ডিসকানেক্ট করা যায়, আপলোড ও ডাউনলোড স্পিড দেখা যায়, কল করা যায়, এসএমএস পাঠানো ও রিসিভ করা যায় ইত্যাদি।

এছাড়াও ফ্ল্যাশ মডেমে রয়েছে মাইক্রো-এসডি কার্ডের জন্য আলাদা পোর্ট। অর্থাৎ, আপনি এই মডেমে সিমের পাশাপাশি মাইক্রো-এসডি কার্ড মেমোরি ঢোকাতে পারবেন। ফলে, মূহুর্তেই আপনার মডেম হয়ে যাবে মেমোরি কার্ড রেডার। এছাড়াও স্থায়ীভাবে সবসময় মেমোরি কার্ড লাগিয়ে রাখলে পেন ড্রাইভ হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবেন এই মডেম। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩২ গিগাবাইট পর্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন মেমোরি কার্ড ঢোকাতে পারবেন এই মডেমে।

জেডটিই নির্মিত টেলিটক ফ্ল্যাশ মডেম সাপোর্ট করে HSUPA/HSDPA/WCDMA (সিটিসেল নয়)/EDGE/GPRS এবং জিএসএম নেটওয়ার্ক। এর মধ্যে টেলিটক ৩জি ব্যবহার করে এইচএসডিপিএ নেটওয়ার্ক। এই মডেমের ডাউনলোডের সর্বোচ্চ ক্ষমতা হচ্ছে ৫.৭৬ মেগাবিট পার সেকেন্ড আপলোড এবং ৭.২ মেগাবিট পার সেকেন্ড ডাউনলোড। বলা বাহুল্য, এই স্পিড কেবল ৩জি (ডব্লিউএসডিপিএ) নেটওয়ার্কে পাবেন।

কিন্তু এটা কেবল মডেমের ক্ষমতা। টেলিটক ৩জি অবশ্যই আপনাকে কখনোই এতো স্পিড দেবে না। তাই কেবল মডেমের ক্ষমতা শুনেই খুশি হওয়ার কিছু নেই। চলুন দেখা যাক কেমন স্পিড পাচ্ছি আমরা।

ভালো দিক

teletalk 3g speed

কানেকশন স্ক্রিনেই আপনি রিয়েল-টাইম আপলোড ও ডাউনলোড স্পিড দেখতে পাবেন।

টেলিটক ৩জি প্রথমে আমরা ব্যবহার করেছি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে স্মার্টফোন এক্সপো ২০১৩ চলাকালীন সময়ে। সেখানে আমরা ফুল কাভারেজ পেয়েছি। সম্পূর্ণ ৩জি নেটওয়ার্কের আওতায় থাকায় ৫১২ কেবিপিএস থেকে ১ এমবিপিএস-এর মধ্যেই স্পিড ওঠানামা করেছে। ডাউনলোডের ক্ষেত্রেও আমরা স্থিতিশীল স্পিড পেয়েছি।

পরবর্তীতে ঢাকার অন্য কয়েকটি লোকেশনেও আমরা টেলিটক ৩জি ফ্ল্যাশ মডেমে ব্যবহার করেছি। যেসব জায়গায় টেলিটক ৩জি নেটওয়ার্ক রয়েছে, সেসব জায়গায় আমরা বেশ ভালো স্পিড পেয়েছি। এছাড়াও মোবাইলে পারফরম্যান্স কেমন থাকে তা পরীক্ষা করার জন্য আমরা ৩জি সুবিধা-সম্পন্ন ডিভাইস এক্সপেরিয়া মিনি প্রো-তে টেলিটক ৩জি সিম ব্যবহার করেছি। ফলাফল ছিল একই রকম। যতক্ষণ ৩জি নেটওয়ার্কের আওতায় থাকা গেছে, ততক্ষণ বেশ সন্তোষজনক ছিল ডাউনলোড ও ব্রাউজিং স্পিড।

teletalk 3g speed

খারাপ দিক

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, টেলিটক ৩জি প্রাথমিকভাবে কেবল ঢাকায় চালু করা হলেও ঢাকার সবখানে আপনি এর নেটওয়ার্ক পাবেন না। এমনকি ওয়াইম্যাক্স নেটওয়ার্কের মতোই অনেক সময় নিচতলায়ও নেটওয়ার্ক পেতে সমস্যা হয়। পরীক্ষা করার সময় আমার বাসায়ই দেখা গেছে এক রুমে নেটওয়ার্ক থাকছে কিন্তু অন্য রুমে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। একবার ডিসকানেক্ট করলে আবার ৩জি নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। এমনকি সম্প্রতি বারিধারা ডিওএইচএস-এও আমরা দেখেছি টেলিটক ৩জি’র নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, যখন ৩জি নেটওয়ার্ক থাকে না, তখন কী হয়?

teletalk 3g net speed

আগেই বলা হয়েছে, টেলিটক ৩জি ফ্ল্যাশ মডেম জিপিআরএস ও এজ নেটওয়ার্ক সাপোর্ট করে। আর তাই যখন ৩জি নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ২জি নেটওয়ার্কের এজ সংযোগ চালু হয়ে যায়। আর এজ সংযোগে সর্বোচ্চ ৩২ কিলোবাইট/সেকেন্ড পর্যন্ত গতি পেয়েছি আমরা, যদিও তা কনস্ট্যান্ট নয়। কারণ, এজ কানেকশন তখনই চালু হয়, যখন টেলিটক ঠিকমতো নেটওয়ার্ক পায় না। তাই এজ-এ কানেক্ট হলে স্পিড অতিরিক্ত ওঠানামা করে।

teletalk 3g

একই সমস্যা আমরা মোবাইলেও দেখেছি। অবশ্য এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। যেখানে নেটওয়ার্ক সমস্যা করবে, সেখানে মোবাইল কি আর ফ্ল্যাশ মডেমই কি, ডেটা স্পিড থাকবে না। আর এটা সত্যিই খুব হতাশাজনক।

টেলিটক ৩জি নিবো নাকি না?

আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন, টেলিটক ৩জি চালু হওয়ার কিছুদিন পর ২জি নেটওয়ার্কে বিশাল সমস্যার সৃষ্টি হয়। কয়েকটি জেলার টেলিটক ব্যবহারকারীরা সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, গ্রাহককে “বাঁধ ভাঙতে” বলে টেলিটক নিজেদের নেটওয়ার্কই ভেঙে ফেলেছে। এই নিয়ে সমালোচনায় পড়লেও টেলিটক দ্রুত সমস্যা দূর করতে সক্ষম হয়েছে।

এছাড়াও টেলিটকের নেটওয়ার্ক নিয়ে অনেক গ্রাহকেরই অভিযোগ শোনা যায়। অনেকটা একই অবস্থা টেলিটক ৩জি’র ক্ষেত্রেও। দেখা যাবে, আপনি এক জায়গায় প্রচুর গতি পাবেন, কিন্তু আরেক জায়গায় কোনো নেটওয়ার্কই পাবেন না, যদিও তা ঢাকারই কোনো ব্যস্ত এলাকা হয়। কোথায় কখন নেটওয়ার্ক থাকবে তা বলা মুশকিল। এমনকি আমি ব্যবহারের সময় একই স্থানে একেক সময় নেটওয়ার্ক নিয়ে সমস্যায় পড়েছি।

তাই অ্যান্ড্রয়েড কথনের পরামর্শ হচ্ছে, এখনই টেলিটক ৩জি নিতে পারেন ব্যাকআপ সংযোগ হিসেবে। অর্থাৎ, কোনো কারণে আপনার মূল ইন্টারনেট সংযোগ (ব্রডব্যান্ড, ওয়াইম্যাক্স, ইত্যাদি) কাজ না করলে টেলিটক ৩জি ব্যবহার করতে পারেন। আর যদি আপনি অনেক যাতায়াত করেন, তাহলেও টেলিটক ৩জি ব্যবহার করতে পারেন। এক জায়গায় না এক জায়গায় হয়তো নেটওয়ার্ক পেয়েই যাবেন।

তবে হ্যাঁ, যদি আপনি যেখানে থাকেন (বাসা বা অফিস) সেখানে টেলিটক ৩জির ফুল নেটওয়ার্ক থাকে, তাহলে হয়তো আপনি টেলিটক ৩জি নেয়ার কথা ভাবতে পারেন। অন্যান্য ইন্টারনেট সংযোগের তুলনায় মোটামুটি সাশ্রয়ীই বলা চলে টেলিটক ৩জি প্যাকেজ প্ল্যান। তবে যদি নেটওয়ার্ক না থাকে, তাহলে হয়তো এখনই টেলিটক ৩জি প্রাথমিক ইন্টারনেট সংযোগ হিসেবে নেয়ার আগে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখতে পারেন। আগে থেকেই নেটওয়ার্ক সঙ্কটে থাকা টেলিটক ৩জি নেটওয়ার্কও সবখানে পৌঁছাতে পারেনি এখনই।

সপ্তাহখানেক ব্যবহারের অভিজ্ঞতা শেষে আমাকে যদি কিনতে হতো তাহলে আমি হয়তো টেলিটক ৩জি কিনতাম না। সৌজন্য হিসেবে পেয়েছি সেই হিসেবে ঠিক আছে। অথবা কেউ সেকেন্ড হ্যান্ড বিক্রি করলেও কেনার কথা ভাবতে পারেন। তবে আপনার বাসায় যদি ফুল নেটওয়ার্ক থাকে, তাহলে কেবল বাসায় ব্যবহারের জন্য টেলিটক ৩জি একেবারেই খারাপ হবে না।

শেষ কথা

টেলিটক ৩জি নিঃসন্দেহে ভালো সেবা দিচ্ছে। যেটুকু সমস্যার কথা আমরা বলেছি সেটা নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে উদ্ভূত। আশা করছি শিগগিরই টেলিটকের নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। অবশ্য আগামী জুনে যদি ৩জি নেটওয়ার্কের নিলাম হয় ও গ্রামীণফোনের মতো অন্যান্য অপারেটররা ৩জি সেবা চালু করে, তাহলে হয়তো টেলিটকের যাত্রা সেখানেই থেমে যাবে। দেখা যাক, ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।

টেলিটক ৩জি ইন্টারনেট সম্পর্কে আপনার কী মত?